Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

অস্বস্তিতে বিজেপির মুসলিমেরা

সেই রাতে এক ছেলে আর চার মেয়ের হাত ধরে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মরিচা বিবি। তার পরে ঘুরে-ঘুরে নানা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থেকেছেন। অথচ তাঁর গোলা ভরা ধান ছিল। আশরফ তাঁদের গ্রামে ঢুকতে দেয়নি। সিপিএমও তাঁদের গ্রামে ঢোকাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বিজেপির হাত ধরে মাস দুয়েক আগে আরও অনেকের সঙ্গে মিছিল করে বেতবেড়িয়া গ্রামে ঢুকেছিলেন মরিচা বিবি। তিনি এখন গ্রামে বিজেপির অন্যতম মুখ। সক্রিয় নেত্রী

মালিয়াপোতায়। নিজস্ব চিত্র

মালিয়াপোতায়। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার, মনিরুল শেখ  
চাপড়া শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৫:৪৩
Share: Save:

বছর ছয়েক আগের কথা।
২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর স্কুল ভোটের দিন খুন হয়েছিলেন তাঁর দেওর আশাদুল শেখ। অভিযোগ ছিল, চাপড়ার তৃণমূল নেতা আশরফ ঘরামি ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।
সেই রাতে এক ছেলে আর চার মেয়ের হাত ধরে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মরিচা বিবি। তার পরে ঘুরে-ঘুরে নানা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থেকেছেন। অথচ তাঁর গোলা ভরা ধান ছিল। আশরফ তাঁদের গ্রামে ঢুকতে দেয়নি। সিপিএমও তাঁদের গ্রামে ঢোকাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বিজেপির হাত ধরে মাস দুয়েক আগে আরও অনেকের সঙ্গে মিছিল করে বেতবেড়িয়া গ্রামে ঢুকেছিলেন মরিচা বিবি। তিনি এখন গ্রামে বিজেপির অন্যতম মুখ। সক্রিয় নেত্রী।
কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের আতঙ্ক এখন মরিচা বিবির প্রতিবেশী ও আত্মীয়দেরও গ্রাস করেছে। অনেকেই তাঁর কাছে জানতে আসছেন, শেষমেশ তাঁদের দেশছাড়া হতে হবে না তো? ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে দেবে না তো? মরিচা বিবি তাঁর মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। বলছেন, ‘‘ভারতীয় মুসলিমদের কোনও ভয় নেই।’’ অনেকে শুনে চলে যাচ্ছে। সামনে কেউ কিছু না বললেও পিছনে কিন্তু অনেকেই বলাবলি করছেন, এই সময়ে মরিচা বিবি বিজেপি না করলেই পারতেন। মরিচার অবশ্য সাফ কথা, “বিজেপি আমার ঘর ফিরিয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে শ্বশুরের ভিটে। আমি ওদের সঙ্গেই আছি।”
মরিচা বিবিদের মতো যে সব মুসলিমেরা এখনও বিজেপি করছেন, তাঁদের অবস্থা কিন্তু ক্রমশ আরও বেশি অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। প্রকাশ্যে স্বীকার করুন বা না করুন, ব্যক্তিগত কথাবার্তায় তাঁদের অনেকেই মেনে নিচ্ছেন সে কথা। তাঁরা নিজেদের মতো করে নানা সংশয়ের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতে যে বিশেষ কাজ হচ্ছে, এমনটা নয়। বরং যে বিজেপিকে বিশ্বাস করতে পারছে না মুসলিম সমাজের বড় অংশ, কিছু লোকজন সেই দলটাই করছে এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। ফলে বিজেপিতে থাকা মুসলিমেরা পড়েছেন উভয় সঙ্কটে।
চাপড়ায় সিপিএম থেকে তৃণমূল ঘুরে বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার ব্লক সভাপতি হয়েছেন রফিক শেখ। গত লোকসভা নির্বাচনের পরে তাঁকে এই পদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরই ঘনিষ্ঠদের কারও-কারও মতে, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তিনি কিছুটা হলেও চাপে পড়ে গিয়েছেন। তবে রফিক শেখের দাবি, “আমি চাপে থাকতে যাব কেন? চাপে থাকবে তো তৃণমূল নেতারা। কারণ মানুষ বুঝে গিয়েছে যে তৃণমূলই ভুল বোঝাচ্ছে।” বলছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর কথায় আত্মবিশ্বাসের সেই সুরটা যেন ঠিক বাজে না।
হরিণঘাটার নগরউখরা ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা সুকুর আলি মণ্ডল প্রথম থেকেই তৃণমূল করে এসেছেন। তাঁর স্ত্রী এক সময়ে তৃণমূলের টিকিটে জিতে হরিণঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যও হন। প্রায় দেড় দশক ধরে তিনি নগরউখরা ২ পঞ্চায়েতে তৃণমূলের সভাপতিও ছিলেন। পরে স্থানীয় তৃণমূল নেতা চঞ্চল দেবনাথের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে দল ছেড়ে যোগ দেন কংগ্রেসে। গত লোকসভা ভোটের বেশ কয়েক মাস আগে বিজেপিতে যোগ দেন। এখন তিনি ওই এলাকায় বিজেপির পরিচিত মুখ। দলের নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলার সংখ্যালঘু মোর্চার নেতাও তিনি।
সুকুর আলি জানান, লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরে ভালই চলছিল। কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার পর থেকেই ঝামেলা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে এলাকার কিছু মুসলিম বাসিন্দা তাঁর বাড়িতে ঢুকে হুমকি দিয়ে গিয়েছেন, আর যা-ই হোক, বিজেপি করা যাবে না। সুকুর বলেন, ‘‘শনিবার আমি একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গেলে সেখানেও লোকজন আমাকে বাজে কথা বলেছে। তবে আমি এতে দমে যাচ্ছি না। এ দেশের হিন্দুরা বহু দিন ধরেই চাইছিলেন যে তাঁরা যেন সহজেই নাগরিকত্ব পান। আর, যে কোনও সরকারেরই উচিত সংখ্যাগুরুর দাবিকে মর্যাদা দেওয়া। সেটাই করেছে বিজেপি।’’ তবে সেই সঙ্গেই সুকুরের উপলব্ধি, ‘‘খুব বেশি মুসলিম ব্যাপারটা বুঝতে চাইছেন না। তৃণমূল মগজ ধোলাই করেছে।’’
বিজেপির হরিণঘাটা মণ্ডলের সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি সাবির আলি মণ্ডলও দাবি করছেন, ‘‘কেন্দ্র তো চাইছে এ দেশের মুসলিমদের না তাড়াতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে সে কথা বলেও দিয়েছেন। তবে মুসলিমদের অনেকেই এটা বুঝতে চাইছেন না।’’ তাঁকেও অনেক কুকথার মুখে পড়তে হচ্ছে। হরিণঘাটা পুর এলাকারই মুড়াগাছায় বহু মুসলিম লোকসভা নির্বাচনের পরে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন। বেশ কয়েকটি গাড়িতে বোঝাই হয়ে রানাঘাটে বিজেপির নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলার প্রধান কার্যালয়ে তাঁরা এক সময়ে সভা করতে যেতেন। কিন্তু নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে বিজেপির সুর চড়াতেই তাঁদের বেশির ভাগই তৃণমূলে ফিরে এসেছেন।
ওই এলাকার নাজির শেখ এক সময় সক্রিয় ভাবে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। শনিবার নাজির বলেন, ‘‘ভাগ্যিস আগেই ওদের ছেড়ে এসেছি। না হলে পাড়ার লোকজন মারধর করত! সত্যিই তো বিজেপি মুসলিমদের দেশছাড়া করার ফন্দি করছে।’’ বিজেপির সদ্যপ্রাক্তন নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি মানবেন্দ্রনাথ রায় অবশ্য দাবি করেন, এই আইন যে মুসলিমদের বিরোধী নয় তার প্রমাণ অচিরেই মিলবে। আজ, রবিবার হরিণঘাটায় বহু মুসলিম এই আইনের সমর্থনে মোটরবাইক মিছিল করবেন। তাঁর সভাপতির পদ যে চলে গিয়েছে, মানবেন্দ্রনাথ সম্ভবত তখনও তা জানতেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE