Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সুকান্তকে জীবনের প্রথম ফোঁটা দিলেন সখিনা

হরিহরপাড়ায় চোঁয়া গ্রামের অখ্যাত ঘরে মঙ্গলবার, ভাইফোঁটার দুপুরে কিছু খুশির রোদ ঠিকরে পড়ল। গ্রামের বৃদ্ধ পুরুতঠাকুর সুভাষ রায়চৌধুরীর স্ত্রী ইলার চোখ তাতে চিকচিক করছিল।

 সুকান্তকে ফোঁটা সখিনার। পাশে কাকলি। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র

সুকান্তকে ফোঁটা সখিনার। পাশে কাকলি। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র

মফিদুল ইসলাম ও ঋজু বসু
হরিহরপাড়া ও কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৫৫
Share: Save:

যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়ার মন্ত্রটা সখিনাকে শেখাতে গিয়েছিলেন প্রিয় সখী কাকলি। খুব একটা দরকার হল না।

‘‘আমি তো জানি রে এটা, সিনেমায় ক-ত দেখেছি ভাইফোঁটা!’’— টরটরিয়ে বলে ওঠেন মুসলিম ঘরের কন্যা। জীবনের প্রথম ভাইফোঁটা দেওয়ার উৎসাহে সকাল-সকাল স্নান সেরে উপোস করে ‘দাদা’র অপেক্ষায় ছিলেন বোন। দাদা সুকান্ত তৈরি হয়ে এলে কাকলি কী ভাবে ফোঁটা দিচ্ছে তা মন দিয়ে দেখেন সখিনা। এর পরে কিছু শেখাতে হয়নি। সখিনা ফোঁটা দেওয়ার সময়ে শাঁখ বাজানো ভুলে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ কাকলি। এ মেয়ে তো সব জানে!

হরিহরপাড়ায় চোঁয়া গ্রামের অখ্যাত ঘরে মঙ্গলবার, ভাইফোঁটার দুপুরে কিছু খুশির রোদ ঠিকরে পড়ল। গ্রামের বৃদ্ধ পুরুতঠাকুর সুভাষ রায়চৌধুরীর স্ত্রী ইলার চোখ তাতে চিকচিক করছিল। ‘‘এত দিন আমার ছেলে সুকান্তকে শুধু ওর নিজের বোন কাকলিই ফোঁটা দিত। এখন তো সখিনাও আমার মেয়ে। ঠাকুরের কাছে চাইব, এ বার থেকে সখিনাও জীবনভর ওর দাদা সুকান্তকে ভাইফোঁটা দিক।’’— বলে ওঠেন ইলাদেবী।

বছরখানেক আগে পড়শি ঘরে স্বামীর মার খেয়ে বিতাড়িত সহায়-সম্বলহীন সখিনাকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয় পাড়াগেঁয়ে ঠাকুরমশাই রায়চৌধুরীর পরিবার। তার পর থেকেই নানা বাধা। মুসলমানের মেয়েকে অন্দরমহলে রাখায় পড়শি মহলের বিরোধিতা যা-ও বা একটু ফিকে হয়, আশপাশের গ্রামে সুভাষবাবুদের যজমানদের ভুল বুঝিয়ে বাঁধা পুজোর দখল কেড়ে নেওয়া চলছেই। পিছু হটেনি গ্রাম্য ব্রাহ্মণ পরিবার। ঠাকুরমশাইয়ের মেয়ে কাকলিও স্বামী-বিচ্ছিন্না। মেয়ের শ্বশুরঘরের অত্যাচার হাড়ে-হাড়ে চেনেন তাঁরাও। যন্ত্রণার ঐক্যই সখিনার সঙ্গে ব্রাহ্মণ পরিবারটির সম্পর্ক গাঢ় করেছে। বন্ধু কাকলির মা-বাবা-দাদার সঙ্গে একই বাড়িতে খুদে ছেলেমেয়েকে নিয়ে শান্তিতে নিজের ধর্ম রোজা-নমাজ পালন করছেন সখিনা। ভাইফোঁটার উৎসব বাড়ির সেই প্রীতির আলোই আরও উজ্জ্বল করে তুলল।

সখিনা আর কাকলি দু’জনেই এ বার পুজোর নতুন সালোয়ার-কুর্তায় সেজে নেন সকাল-সকাল। প্রথম ভাইফোঁটায় দাদার উপহার কিনতে কাকলিকে নিয়ে আগে হরিহরপাড়ায় যান সখিনা। যৎসামান্য জমানো টাকায় ফিকে গোলাপি টি শার্ট কিনেছেন। সুকান্তও বোনেদের অবাক করে তাঁতের শাড়ির প্যাকেট দেন। সকাল থেকে লুচি ভাজা চলছিল। সঙ্গে নারকোলের বরফি, সুজি করেছেন ইলাদেবী। তাঁর স্বামীকে ভাইফোঁটা দিতে ননদও বাড়িতে এসেছেন। দুপুরের মেনু ভাত, মুগের ডাল, পটলভাজা, বেগুনভাজা, মুলোশাক, খাসির মাংস, দই, মিষ্টি। ফোঁটা নিয়ে সুকান্ত বলেন, ‘‘দু’টি লক্ষ্মী বোন পাওয়া ভাগ্য।’’ সখিনা বললেন, ‘‘নিজের ঘর, আত্মীয় হারিয়েযে আবার এমন একটি পরিবার, নিজের দাদা খুঁজে পাব কখনও ভাবিনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bhai Phota Hindu Muslim Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE