Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্ট্রোকের ঝড় সামলে উঠলেও ছাপ মোছাটা জরুরি

বাস শ্যামবাজার মোড় ছাড়ানোর পরেই আচমকা মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল চালকের। চার পাশে সব কিছু অন্ধকার। কোনও মতে ব্রেক কষে রাস্তার এক পাশে বাসটা দাঁড় করিয়ে স্টিয়ারিংয়ের উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১৬
Share: Save:

বাস শ্যামবাজার মোড় ছাড়ানোর পরেই আচমকা মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল চালকের। চার পাশে সব কিছু অন্ধকার। কোনও মতে ব্রেক কষে রাস্তার এক পাশে বাসটা দাঁড় করিয়ে স্টিয়ারিংয়ের উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। আর কিছু মনে নেই। হাসপাতালে যখন জ্ঞান ফিরেছিল, ততক্ষণে শরীরের একটা দিক অসাড়! ডাক্তার দেখে জানান, ব্রেন স্ট্রোক।

দিন আনা-দিন খাওয়া পরিবারের প্রৌঢ় গৃহকর্তার জীবনে আচমকা এমন অন্ধকার নেমে আসায় তাঁর পরিজনেরা প্রায় সব শেষ বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার ওই বাসচালক শুধু তাঁর পুরনো কাজেই ফেরেননি, কার্যত দৌ়ড়ে বেড়াচ্ছেন। এমন একটা রোগ যে তাঁর শরীরে কখনও থাবা বসিয়েছিল, তাই এখন ভুলতে বসেছেন তাঁর পরিজনেরা।

এ ভাবে ফিরে আসার ঘটনাকে কিছুটা ‘ব্যতিক্রমী’ বলেই মনে করছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, স্ট্রোকের রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন, সেই সচেতনতা এখনও ভাল করে গড়ে ওঠেনি সাধারণ মানুষের মধ্যে। ফল হিসেবে পঙ্গুত্ব, বিস্মৃতি, গভীর মানসিক অবসাদে ডুবে যাচ্ছেন অনেকেই। শনিবার, বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে এই সচেতনতা বাড়ানোর উপরেই জোর দিয়েছেন তাঁরা।

ফিজিক্যাল মেডিসিন-এর চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে যে কোনও ব্যক্তির মস্তিষ্কের ৩০% কোষ সক্রিয় থাকে। বাকি ৭০% থাকে ঘুমন্ত। স্ট্রোকের পরে যখন সক্রিয় কোষগুলি নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন ওই ৭০% সুপ্ত কোষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা হয় নানা থেরাপির মাধ্যমে। উদ্দেশ্য স্ট্রোকের পরেও পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরে যেতে সহায়তা করা। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলা হয়, ‘স্ট্রোক রিহ্যাবিলিটেশন’। তবে এ ক্ষেত্রে সময় মতো থেরাপি শুরু করাটাই সবচেয়ে জরুরি।

কিন্তু স্ট্রোকের পরে যাঁদের উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়, বা যাঁদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে ক্ষতির পরিমাণটা অনেকটা জায়গা জুড়ে — তাঁদের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফেরা কঠিন, জানাচ্ছেন মৌলিমাধববাবু। তাঁর কথায়, ‘‘এঁদের কিছু সমস্যা থেকেই যায়। কারও হয়তো একটা হাত বা পা পুরোটা সচল হল না, কারও হয়তো কথাবার্তায় জড়তা থেকে গেল। এই সব ক্ষেত্রে আমরা দেহের বাকি অংশগুলোকে বেশি সক্রিয় রাখার চেষ্টা করি।’’ কী রকম? ওই চিকিৎসক জানান, ধরা যাক কারও একটা হাত তেমন সচল নেই। সে ক্ষেত্রে অন্য হাতটাকে থেরাপির মাধ্যমে বেশি কর্মক্ষম করার চেষ্টা হয়। যাতে ‘প্রায় অচল’ হাতের কাজ ‘সচল’ হাতটি একাই করতে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, স্ট্রোক হল আদতে একটা বিশাল ঝড়, যা থেমে যাওয়ার পরেও বড়সড় ছাপ রেখে যায়। সেই ছাপটাকে সরানোই বড় চ্যালেঞ্জ। স্নায়ু রোগ চিকিৎসক শ্যামল দাসের আক্ষেপ, ‘‘স্ট্রোকের বহু রোগীকে দেখি বাকি জীবনটা পঙ্গু হয়ে রয়েছেন। আসলে স্ট্রোকের পরে দিন কয়েকের চিকিৎসাই যে সব নয়, অধিকাংশ মানুষ সেটাই জানেন না। এমনকী, ডাক্তারদের মধ্যেও এ নিয়ে সম্যক ধারণার অভাব রয়েছে। তাই স্ট্রোকের পরে রোগীকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেওয়াটাই ‘চিকিৎসা শেষ’ বলে মনে করেন অনেকে। আসলে সেটা শেষ নয়, চিকিৎসার মাঝ পথ বলা যায়।’’

শ্যামলবাবু মনে করিয়ে দেন, ‘‘স্ট্রোক রোগীর পুনর্বাসনের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, কাউন্সেলিং — সবই প্রয়োজন হয়। এ জন্য ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগে। দু’-চার দিনে হতাশ হয়ে পড়লে কিন্তু চলবে না।’’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৫৮ লক্ষ মানুষ স্ট্রোকে মারা যান। স্ট্রোক হল মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং পঙ্গুত্বের চতুর্থ বৃহত্তম কারণ। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, স্ট্রোক হওয়ার প্রথম দু’-তিন দিনের মধ্যেই রিহ্যাব প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া উচিত। সাধারণ ভাবে স্ট্রোকের পরে প্রথম ৪০ দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়কাল পেরিয়ে যাওয়ার পরে রিহ্যাব শুরু হলে সাড়া পাওয়ার আশা কার্যত তলানিতে গিয়ে ঠেকে। মনোরোগ চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদার এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘যদি দেখা যায় স্ট্রোকের পাঁচ-ছ’ সপ্তাহ পরেও কেউ বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা

করছেন না, খাওয়াদাওয়ায় অনীহা রয়েছে, সব সময়ে হতাশ হয়ে থাকছেন, বিরক্ত হচ্ছেন অল্পেতেই — তা হলে ধরে নিতে হবে স্ট্রোকের পথ ধরেই অবসাদও গ্রাস করছে তাঁকে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই রোগীকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে নিউরোলজিস্টদের বড়সড় ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা যদি রোগীর পরিবারকে এ ব্যাপারে সচেতন করেন, তা হলে চিকিৎসাটা অনেক আগে শুরু হতে পারে।’’

স্ট্রোক কী

মস্তিষ্কের ভিতর রক্তের নালি আটকে গিয়ে বা ফেটে গিয়ে সেখানকার কোষগুলিতে রক্তচলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। একেই বলে স্ট্রোক। এর ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক দিকের শরীর অবশ হওয়া, কথাবার্তায় অসংলগ্নতা, আচমকা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মলমূত্র ত্যাগের নিয়ন্ত্রণ হারানো, চোখে দেখতে না পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এ ছাড়া সামান্য মাথা ঘুরে যাওয়া, মুখ অল্প বেঁকে যাওয়া বা হাত-পা অল্প ক্ষণের জন্য অবশ হয়ে যাওয়াও এক ধরনের স্ট্রোক। একে বলে ট্রানসিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাক (টিআইএ)। চিকিৎসকদের মতে, টিআইএ হলে পরবর্তী সময়ে বড়স়ড় স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

consumption of medicine Stroke Necessary steps
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE