Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বইয়ের পড়ায় মন টানছে জুঁই, প্লুটো

দুই এক্কে দুই... দুই দু’গুণে চার... মন না-বসার ইতিহাসটা ফি বছরের। আর সেই সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায় অভাবী পরিবারের শিশুদের। কালো কালো ছাপা অক্ষরের একঘেয়েমি, আর বুঝতে না-পারা পড়ার বোঝার উপর চেপে বসে বাড়ির কাজের চাপ, রোজগারের চিন্তা।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৩
Share: Save:

দুই এক্কে দুই... দুই দু’গুণে চার... মন না-বসার ইতিহাসটা ফি বছরের। আর সেই সমস্যা আরও জটিল হয়ে যায় অভাবী পরিবারের শিশুদের। কালো কালো ছাপা অক্ষরের একঘেয়েমি, আর বুঝতে না-পারা পড়ার বোঝার উপর চেপে বসে বাড়ির কাজের চাপ, রোজগারের চিন্তা। ক্রমশ বে়ড়ে চলে স্কুলছুটের সংখ্যা। সেখান থেকে ছোটদের বের করে আনতে নতুন করে তাই ভাবনাচিন্তা করছেন শিক্ষাবিদরা। তেমন চেষ্টার ছবি দেখা গেল বীরভূমে।

একটা সাইকেল চাকার পরিধি, বেধ, মিটার, কিলোমিটারের অঙ্ক গ্যাঁট হয়ে রোজই বসে থাকে বইয়ের পাতায়। সেই চাকাটা গড়িয়ে গড়িয়ে যদি দেখা যায় কতটা রাস্তা এগোল সাইকেল, তবে অঙ্কটা বোঝা সহজ হয়ে যায়। আবার চাকা গড়ানোর পরীক্ষাটা ক্যামেরাবন্দি করে যদি তৈরি করে ফেলা যায় একটা ভিডিও, অঙ্কটা দিয়ে যদি তৈরি হয়ে যায় একটা সিনেমা— পড়ার মানেটাই বদলে যায় তবে। তেমন করেই অঙ্কটা খাতায় কলমে কষে ফেলেছিল নমিতা, লাল্টু, সঞ্জয়রা। সেটাই হয়ে গিয়েছে ছবি।

ওরা বেশির ভাগই প্রথম প্রজন্মের প়ড়ুয়া। বাড়ি বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামেরই স্কুলে পড়াশোনা। কিন্তু ওদের আলাদা করে দিয়েছে একটা নতুন চেষ্টা। টাটা ট্রাস্টের উদ্যোগে ‘ইন্টিগ্রেটেড অ্যাপ্রোচ টু টেকনলজি ইন এডুকেশন’ (আইটিই) প্রকল্পের কাজ চলছে নোয়ালডাঙায়। কয়েকটা ল্যাপটপ, গোটা দুই ক্যামেরা, একটা টেপ রেকর্ডারে পড়াশোনার মানে বদলে যাচ্ছে। টাটা ট্রাস্টের তরফে ওই প্রকল্পের প্রধান আমিনা চারানিয়া বলেন, ‘‘সরকারি স্কুলে ‘কম্পিউটার লিটারেসি’ নিয়ে কাজ হয়। আমরা চাই না বাচ্চারা শুধু কম্পিউটারের খুঁটিনাটি শিখুক। বরং তারা তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রটাকে আর একটু বিস্তার করে নিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে।’’

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বোলপুরের কাছে ওই গ্রামে কাজ করছে টাটা ট্রাস্ট। সঙ্গী এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যাঁরা মূলত আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্যই কাজ করে। যৌথ উদ্যোগে নোয়ালডাঙায় তৈরি হয়েছে একটি রিসোর্স সেন্টার। স্কুল যাওয়ার আগে সকাল সাড়ে ৬টায় পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির পড়ুয়ারা হাজির হয় সেখানে। প্রায় ৪৫ জন। ভ্যান চালিয়ে হাজির হন শিক্ষকরাও। সঙ্গে আনেন চাটাই, মাদুর আর সূর্যমুখী, জুঁই, মার্স, প্লুটো—এগুলো ল্যাপটপের নাম। পড়ুয়াদের দেওয়া। সংস্থাটির কর্ণধার রাহুল বসু বলেন, ‘‘পড়ার বইকে নতুন করে দেখছে ওরা ল্যাপটপে। উৎসাহও বেড়েছে। বাচ্চাদের মধ্যে স্কুল কামাই করার প্রবণতাও কমেছে।’’ পাকা হাতে ‘এক্সেল’ সামলে, ‘গ্রাফ’ এঁকে বিশ্বনাথ কোঁড়া, নমিতা হেমব্রমরা বুঝিয়ে দিয়েছে গত একমাসে কতটা বেড়েছে উপস্থিতি। নমিতা উৎসাহ বাঁধ মানে না, ‘‘স্কুলের অনেক বন্ধুরাই তো এ ভাবে পড়াশোনা করার সুযোগ পায় না। তাদের আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি ক্লাসে না-এলে কত রকম অসুবিধা।’’ ছবি বানানোর নেশা পেয়ে বসেছে নবম শ্রেণির লাল্টুকে। টুকরো টুকরো ছবি বানাতে বানাতে স্বপ্ন বোনে সে, ‘‘পরিচালক হতে চাই। অনেক কিছু শিখতে হবে।’’ স্থানীয় যুবক যুবতীরা অনেকেই এই আইটিই-র আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁরাই এখন ছোটদের সঙ্গে কাজ করছেন।

বীরভূমে আরও দু’টি স্কুলে চলছে এই কাজ। শেহলাই প্রাথমিক স্কুল এবং বে়ড়গ্রাম উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে। কলকাতা, হুগলি-সহ রাজ্যের বেশ কিছু জেলায়, উত্তরপ্রদেশ, অসম, মহারাষ্ট্রে কাজ করছে টাটা ট্রাস্টের আইটিআই। প্রকল্পে বড় সাফল্য মাদ্রাসাগুলির ক্ষেত্রে, জানন আমিনা। হুগলির দারুন্নেদা সিদ্দিকি মাদ্রাসায় তিন মাস চলছে প্রকল্পের কাজ। টাটার সহযোগী এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্থার তরফে ববিতা মজুমদার জানান, ‘‘এখন পৃথিবীটা ওদের কাছে কাছের। ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে ওরা মিলিয়ে নিতে শিখছে বিশ্বকে। ওদের মধ্যেও কেউ হতে চাইছে নভোচর, কেউ বিজ্ঞানী।’’ দশম শ্রেণির শেখ সাহাবুদ্দিন বলে, ‘‘ছোট থেকেই যদি এ ভাবে প়ড়তে পারতাম, ভাল হত!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Children Education school studies
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE