Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পারিবারিক স্বাস্থ্যের তাগিদেই শৌচাগার, অভাব উপলব্ধির

বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের বক্তব্যের একমাত্রিক উপলব্ধি থেকে দু’-এক জনের মধ্যে যা-ও বা কিছু ধারণা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে স্বাস্থ্যের বিষয়টি নেই। তাঁরা মনে করেন, শুধু বাড়ির মেয়েদের সম্মান রক্ষার জন্যই শৌচাগার প্রয়োজন, নইলে তা না হলেও চলে।

চলছে ‘মিশন নির্মল বাংলা’র প্রচার। ফাইল ছবি

চলছে ‘মিশন নির্মল বাংলা’র প্রচার। ফাইল ছবি

পুষ্পেন চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৩৪
Share: Save:

নববধূ বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে এসে আবিষ্কার করেন, শ্বশুরবাড়িতে শৌচাগার নেই। শৌচ সারতে তাঁকে যেতে হবে খোলা আকাশের নীচে। প্রতিবাদ করায় শ্বশুরমশাই উৎকন্ঠা আর বিপন্নতা নিয়ে বলেন, ‘‘যে আঙ্গিনায় তুলসি গাছ লাগাই, সেখানে শৌচকর্ম করা শুরু করি (যিস্ আঙ্গন মে তুলসী লগাতে হ্যায় ওঁহা শৌচ করনা শুরু কর দেঁ)?’’ ঐতিহ্য এবং সংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি তুলসি এবং শৌচাগারের সহাবস্থান মানতে পারেননি। ‘টয়লেট-এক প্রেমকথা’ সিনেমার শ্বশুর চরিত্রটির এই সংশয় অচেনা নয়। তবে সংস্কারের নামে এই সংশয় ভাঙা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুচিতার ধারণা যে কোনও ধর্ম-সংস্কারেই বেশ পুরনো। কিন্তু এই ধারণার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের অগ্রগতিকে মেলানোর ক্ষেত্রে আমাদের দেশ, আমাদের ধর্ম-সংস্কার কোথাও ব্যর্থ বলে মনে হয়। তাই পুজো-উপাসনায় বসার আগে স্নান বা কাপড় পরিবর্তনের উপরে বা শৌচকর্মের পরে কাপড় পরিবর্তনে যে জোর, সে জোর খাওয়ার আগে বা শৌচের পরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ায় পড়েনি। অবিজ্ঞান ও শুচিবায়ুর কুসংস্কার প্রাধান্য ও প্রশ্রয় পেয়েছে। অন্য দিকে, অশিক্ষা, দারিদ্র ও বিলম্বিত নগরায়নের কারণে শৌচাগারের ধারণাও গ্রামবাংলায় তেমন করে শিকড় পায়নি।

পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে খোলা মাঠে মলত্যাগ করা মানুষের সংখ্যা বিশ্বে সর্বাধিক। সারা বিশ্বে যত মানুষ খোলা মাঠে মলত্যাগ করেন, তার অর্ধেকের বাস ভারতে। এ ক্ষেত্রে, আমরা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানেরও পিছনে। এই দীনতা থেকে উত্তরণের উদ্দেশে সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ হিসাবে এল ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ এবং বাংলায় ‘মিশন নির্মল বাংলা’।

‘মিশন নির্মল বাংলা’র কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, সার্বিক টীকাকরণের পরে সামাজিক স্বাস্থ্য-সুরক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। তবে প্রশ্ন থাকবে যে, অবিভক্ত বর্ধমান জেলার ক্ষেত্রে কি প্রতিটি মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে? উত্তর, না। শৌচাগার তৈরির ক্ষেত্রে অঞ্চল ভেদে গুণগত মানেরও কিছু পার্থক্য থেকে থাকবে। কিন্তু সেটুকু আঁধারের দিকে আঙুল তুলে সাফল্যকে ঢাকা উচিত হবে না।

‘মিশন নির্মল বাংলা’য় মূল যে দুটি কার্যক্রম ছিল, তার একটি হল ১০,৯০০ টাকায় শৌচাগার নির্মাণ আর অন্যটি নিরন্তর প্রচার। এর সঙ্গে অবিভক্ত বর্ধমানের
তৎকালীন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন যেটি কার্যকর ভাবে চালু করেছিলেন, তা হল— সকাল-সন্ধ্যায় নজরদারি। গত দু’বছরে অবিভক্ত বর্ধমানে প্রায় চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার শৌচাগার তৈরির পাশাপাশি নিরন্তর প্রচার ও নজরদারি হয়েছে।

প্রাথমিক ভাবে প্রশাসন যখন মিশন নির্মল বাংলার কাজ শুরু করে, তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। এক-একটি গ্রামে কয়েকটি সম্পন্ন ও শিক্ষিত পরিবারের বাইরে আর কোথাও শৌচাগার নেই। শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা নেই। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের বক্তব্যের একমাত্রিক উপলব্ধি থেকে দু’-এক জনের মধ্যে যা-ও বা কিছু ধারণা তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে স্বাস্থ্যের বিষয়টি নেই। তাঁরা মনে করেন, শুধু বাড়ির মেয়েদের সম্মান রক্ষার জন্যই শৌচাগার প্রয়োজন, নইলে তা না হলেও চলে। কেউ কেউ ভাবেন, মলত্যাগ করা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিনি তা বন্ধ ঘরে করবেন না মুক্ত প্রান্তরে করবেন, সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত।

কোথাও বা শুনতে হয়েছে, ‘সরকার যদি শৌচাগার বানিয়ে না দেয়, তো আমি মাঠেই যাব’। অর্থাৎ, নিজের পরিবারের স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে যে শৌচাগার—সে সচেতনতা নেই। বিষয়টা যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু ‘সরকারের সিদ্ধান্ত’। এরই মধ্যে যাঁদের পরিবারে শৌচাগার রয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা তাদের প্রতিবেশীদের শৌচাগার না থাকার বিষয়ে উদাসীন থাকেন। আসলে তাঁদের পরিবারে শৌচাগার থাকায় তাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত বলে মনে করেন। কিন্তু বুঝতে পারেন না, যত দিন না পড়শি পরিবারগুলিও শৌচাগার ব্যবহার করতে শুরু করছে, তত দিন শৌচাগার থাকা পরিবারও একই রকমের বিপন্ন।

খোলা মাঠে মলত্যাগের অভ্যাসের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রশাসন এ কথাও বলেছে যে, আপনার পরিবারের কাউকে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত করে, আপনি নীরব থাকবেন না প্রতিবাদ করবেন? আপনার যে প্রতিবেশী মাঠে মলত্যাগ করছেন, তিনি কিন্তু আপনার বা আপনার শিশুর ডায়েরিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড বা কৃমির জন্য দায়ী। কারণ, যে মল মাঠে পড়ে রইল, তা ধুয়ে চলে আসে পুকুরে। ওই পুকুরে হয়তো আপনার বাড়ির বাসন মাজা হয়, আপনি স্নান করেন! সেই জলই হয়তো মিশে যাচ্ছে আপনার পানীয় জলে! তার সঙ্গে রয়েছে মশা, মাছির মতো বাহক। এই ক্ষতি কি সামান্য?

উন্মুক্ত মলে উপস্থিত জীবাণু ভারতের প্রায় চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ শিশুর অপুষ্টির অন্যতম কারণ হিসাবে একাধিক সমীক্ষায় চিহ্নিত। সুতরাং, বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, শুধু মহিলাদের আব্রু নয়, শৌচাগারের ব্যবহার সার্বিক স্বাস্থ্যের প্রেক্ষিতেও কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাস্থ্য-দীন প্রজন্ম নিশ্চয় সুস্থ ভারতের দায়িত্ব নিতে পারবে না।

লেখক পূর্বস্থলী ১-এর বিডিও

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nirmal Bangla Toilet Awareness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE