সিরিয়া থেকে বাংলা। আরব মুলুকের জিহাদি সন্ত্রাসের আগুনকে এ রাজ্যের মাটিতে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কোনও গ্রামে প্রথম ঘাঁটি তৈরির ছক কষেছিল ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আর সে জন্য সিরিয়ার জঙ্গি সংগঠনটি ভরসা করেছিল মুর্শিদাবাদের এক বাসিন্দার উপরে, যে কিনা পেশায় রাজমিস্ত্রি হলেও বোমা বাঁধায় সমান দড়।
আইএস নেটওয়ার্কের সুলুক-সন্ধান জানতে সেই লোকটিকে আপাতত হন্যে হয়ে খুঁজছে এনআইএ।
জাতীয় তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, জঙ্গি ঘাঁটি পত্তনের ব্যাপারে কথাবার্তা পাকা করতে মাস দুয়েক আগে হায়দরাবাদ থেকে এ রাজ্যে ঝটিকা সফরে এসেছিল আইএসের এক এজেন্ট। মহম্মদ নাফিস খান নামে সেই এজেন্টের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির বৈঠক হয় গত ৬ জানুয়ারি, হুগলির ধনেখালিতে। টাকাপয়সা ও হাতিয়ার জোগানের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি হয়। ২১ জানুয়ারি হায়দরাবাদে এনআইএ-র হাতে ধরা পড়ে যায় নাফিস। তখন থেকে রাজমিস্ত্রিও বেপাত্তা।
তবে গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: নাফিসের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির মোলাকাতের মূল মাধ্যম ছিল ধনেখালির ছেলে আসিক আহমেদ ওরফে রাজা। কাঁকসার পলিটেকনিক কলেজের ছাত্রটি আইএস-সংশ্রবের অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছে। এনআইএ সোমবার রাতে তাকে বিমানে চাপিয়ে দিল্লি নিয়ে যায়। রাজধানীর জয় সিংহ রোডে এনআইএ’র সদরে মঙ্গলবার সকাল থেকে দফায় দফায় তার জেরা চলছে।
এবং এনআইএ-সূত্রের দাবি: নিজের আইএস-যোগ সম্পর্কে আসিফ নানা তথ্য দিচ্ছে। ঊনিশ বছরের ছেলেটি জানিয়েছে, সিরিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে থাকা আইএস নেতা সফি আরমার তার উপরেই পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনের প্রথম শাখাটি খোলার ভার সঁপেছিল, যে কাজে সাহায্য করতে পাঠানো হয় নাফিস ওরফে আক্রমকে। নাফিস গত ৫ জানুয়ারি রাজবাঁধে আসিকের ডেরায় এসে ওঠে। পর দিন তাকে নিয়ে আসিক চলে আসে ধনেখালির দশঘড়ার বাড়িতে।
আসিক জেরায় জানিয়েছে, দশঘড়া এলাকার চার-পাঁচ জন ছেলে আইএসে যোগদানে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। পরিকল্পনা নিয়ে নাফিসের সঙ্গে তারা একাধিক বার আলোচনায় বসে। রাজমিস্ত্রির খোঁজ তারাই দেয়। ‘‘লোকটা দশঘড়ায় এসেছিল বাড়ি বানাতে। আসিকরা জানতে পারে, তার বোমা তৈরির হাত দারুণ, বোমা-কারবারের নানা চাঁইয়ের সঙ্গেও ভাল ওঠা-বসা। সেই সূত্রে ওকে আইএস-ঘাঁটি তৈরির ভার দেওয়া হয়।’’— বলছেন এক তদন্তকারী।
এনআইএ’র খবর: নাফিস ও আসিকদের সঙ্গে আয়োজিত ‘বৈঠকে’ রাজমিস্ত্রি জানায়, মুর্শিদাবাদ সীমান্তে সে গোপন আস্তানা গড়ে তুলতে পারবে। সেখানে যেমন বন্দুকবাজির তালিম চালানো যাবে, তেমন জোরালো বোমাও বানানো সম্ভব। শুনে নাফিস আশ্বাস দেয়, টাকা-পয়সা সমস্যা হবে না। বস্তুত ‘আস্তানা’র জমি খোঁজার জন্য ওই দিনই (৬ জানুয়ারি) সে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে দেয়।
দশঘড়ায় ‘বৈঠক’ সেরে নাফিস দিল্লি চলে গিয়েছিল। দু’সপ্তাহের মধ্যে সে গোয়েন্দা-জালে ধরা পড়ে। আসিকও এখন কব্জায়। কিন্তু রাজমিস্ত্রির হদিস নেই। এনআইএ-কর্তাদের বক্তব্য: আইএসের বঙ্গ মডিউলে পাকা মাথা বলতে সে-ই। আসিকরা কার্যত কিশোর। তারা সোশ্যাল মিডিয়া মারফত সিরিয়ায় যোগাযোগ রাখত। কিন্তু নাশকতার চক্রান্তের নেপথ্যে রাজমিস্ত্রির ভূমিকাই মুখ্য। এ হেন ব্যক্তির নাগাল না-পেয়ে গোয়েন্দারা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। আসিক ওর নামটুকুই বলতে পেরেছে। জানাতে পারেনি, ওর বাড়ি মুর্শিদাবাদের ঠিক কোন তল্লাটে। শুধু বলেছে, লোকটি বাংলাদেশ সীমান্তে নদীর ধারে ঘাঁটি গাড়তে চেয়েছিল। গোয়েন্দাদের হাতেও তার নাম ও মোবাইল নম্বর ছাড়া কিছু নেই। ফোনটি অবশ্য সুইচ্ড অফ।
এমতাবস্থায় নাফিস-আসিককে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করতে চাইছে এনআইএ, যাতে আরও কিছু সূত্র বা তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু নিপাট বাঙালি ঘরের ছেলে আসিক কি সত্যিই আইএস-মনোভাবাপন্ন?
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একাংশ এমনটা মনে করলেও অন্য অংশ এখনই একশো শতাংশ নিশ্চিত নন। ওঁদের বক্তব্য, আসিক অপরিণতমনস্ক। হতে পারে, কৌতূহল ও আবেগ থেকে খানিকটা এগিয়েছিল। ‘‘ও কোনও দায়িত্ব পালনের পক্ষে কতটা উপযুক্ত, সেটা যাচাই করে দেখতেই নাফিস এখানে আসে। এখনও বোঝা যাচ্ছে না, আইএস-নেতৃত্বের তরফে আসিককে আদৌ কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিনা।’’— মন্তব্য এক এনআইএ-কর্তার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy