Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

জমি বণ্টনে অবৈধ কিছু করিনি, ফের দাবি গৌতমের

বাম আমলে রাজারহাটের জমি ‘কোটা’য় বিলি নিয়ে বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিল কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের জেরে। বিতর্ক সামাল দিতে অসুস্থ শরীরেই ফের আসরে নামতে হল প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবকে। আদালতের রায়ের পরে বৃহস্পতিবার আলিমুদ্দিনে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি দাবি করলেন, কোটায় জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে তিনি অবৈধ কিছু করেননি। বরং, এই ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্ধারিত রূপরেখা মেনেই তিনি কাজ করেছেন বলে প্রাক্তন মন্ত্রীর যুক্তি।

সাংবাদিক বৈঠকে গৌতম দেব। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র।

সাংবাদিক বৈঠকে গৌতম দেব। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৫ ০৩:২১
Share: Save:

বাম আমলে রাজারহাটের জমি ‘কোটা’য় বিলি নিয়ে বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিল কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের জেরে। বিতর্ক সামাল দিতে অসুস্থ শরীরেই ফের আসরে নামতে হল প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেবকে। আদালতের রায়ের পরে বৃহস্পতিবার আলিমুদ্দিনে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি দাবি করলেন, কোটায় জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে তিনি অবৈধ কিছু করেননি। বরং, এই ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্ধারিত রূপরেখা মেনেই তিনি কাজ করেছেন বলে প্রাক্তন মন্ত্রীর যুক্তি।

আবাসনমন্ত্রী হিসাবে বাম আমলে হিডকো-র চেয়ারম্যান ছিলেন গৌতমবাবুই। বাম জমানায় রাজারহাট-নিউ টাউনে বহু জমি জোর করে নেওয়া হয়েছে এবং চেয়ারম্যান নিজের ইচ্ছেমতো জমি বিলি করে ‘প্রভাব’ বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন, বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে এই অভিযোগ বারেবারেই করে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় এসে মমতার সরকারই জানায়, ২০১১ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যানের বিশেষ কোটায় কিছু প্লট বিলি করার সিদ্ধান্ত নেয় হিডকো। পরের দিন অর্থাৎ ১ মার্চ বিধানসভার ভোট ঘোষণা হয়। ভোটের দিন ঘোষণার কথা জেনেও ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে গৌতমবাবু কিছু জমি বিলি করেছেন, এই যুক্তি দেখিয়ে তৃণমূলের সরকার ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে। চেয়ারম্যানের ওই কোটা তুলে দেওয়ারও নির্দেশ জারি হয়। ওই নির্দেশের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন জমি প্রাপকদের একাংশ। ওই আবেদনের মামলায় রায় দিতে গিয়ে বুধবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ‘এই প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ, অবৈধ। এতে চেয়ারম্যানের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে।’ ওই কোটায় ২০০০ সাল থেকে যাঁরা জমি পেয়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা হিডকোর ওয়েবসাইটে এবং দু’টি বহুলপ্রচারিত সংবাদপত্রে প্রকাশ করার নির্দেশও দেন বিচারক।

অতীতে বেশ কয়েক বার এই প্রশ্নে যা জবাব দিয়েছেন, এ বারের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সেই দাবিই ফের জোরালো ভাবে পেশ করার চেষ্টা করেছেন গৌতমবাবু। তাঁর দাবি, ‘‘বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সকলেরই কিছু স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (ডিসক্রিশনারি পাওয়ার) আছে। হিডকোর চেয়ারম্যানেরও আছে। সেই ক্ষমতা বলেই বিচারপতি, সরকারি আমলা, ক্রীড়াবিদ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের চেয়ারম্যান কোটায় জমি দেওয়া হয়েছে।’’ হাইকোর্টের রায়কে হাতিয়ার করে তৃণমূলের তরফে বলা হচ্ছিল, গৌতমবাবুর আমলে ‘বেআইনি’ কাজই বিচারপতির বক্তব্যে স্পষ্ট। দক্ষিণ ভারত থেকে ফের চিকিৎসা সেরে দু’দিন আগেই কলকাতায় ফিরেছেন গৌতমবাবু। দলের বাইরে এবং ভিতরে তাঁর সমালোচকেরা তির শানাতে পারেন বুঝেই গৌতমবাবু এ দিন দাবি করেছেন, তিনি আইন মেনেই যা করার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রাক্তন কংগ্রেস নেত্রী শীলা কলের বিরুদ্ধে কোটায় জমি-বণ্টন সংক্রান্ত মামলার পরে সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছিল, তা মেনেই নিউটাউনে জমি বণ্টন করা হয়েছে। হিডকো ছিল একটি লাভজনক কোম্পানি। আইন-কানুন মেনেই বিজ্ঞাপন দিয়ে চেয়ারম্যানের কোটায় ৫% জমি বণ্টন করা হয়েছে।’’

ডিসক্রিশনারি পাওয়ার বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বলতে কী বোঝায়, তা এ দিন ব্যাখ্যা করেছেন গৌতমবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সারদা মামলায় সৃঞ্জয় বসুর জামিন হয়েছে। কিন্তু মদন মিত্রের হয়নি। কেন হয়নি? কারণ, জামিন দেওয়া বিচারপতির ডিসক্রিশনারি পাওয়ারের মধ্যে পড়ে।’’ তাঁর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করেই বিভিন্ন ক্লাবকে টাকা দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সংস্থাকে ভাগ করে কলকাতা পুরসভাকে ত্রিফলা আলোর বরাত দিতে বলেছিলেন মেয়রকে, এটাও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার প্রয়োগ বলেই গৌতমবাবুর দাবি।

গৌতমবাবুর যুক্তি শুনে এ দিন তৃণমূলের তরফে পাল্টা আর কোনও দাবি করা হয়নি। তবে শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘গৌতমবাবু তো আদালতকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন! আর তিনি হয়তো কোটার পক্ষে আইনি যুক্তি দিচ্ছেন। কিন্তু কোটায় জমি দিয়ে নানা জনকে হাতে রাখার চেষ্টা, এটা কি আদৌ নৈতিক কাজ হয়েছিল?’’

রাজ্যের বর্তমান স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে একাধিক আইএএস, আইপিএস, তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল থেকে শুরু করে ক্রীড়াবিদ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং কিছু বিচারপতিও— বিভিন্ন ব্যক্তিকে কোটায় জমি দেওয়া হয়েছে বলে গৌতমবাবু জানান। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘যদি কাজটা বেআইনিই হতো, তা হলে তৃণমূল সরকারে আসার পরে কেন কোটায় বণ্টন করা সেই জমিগুলির মধ্যে ১৪৭টি জমির দলিল করল বর্তমান রাজ্য সরকার?’’ রাজ্যের বর্তমান প্রশাসনের এক শীর্ষ আমলা যে সে সময় হিডকোর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তা-ও উল্লেখ করেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী। আমলাদের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, তাঁরা প্রশাসনের যন্ত্র মাত্র। নীতিগত সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন না।

বিধানসভার ভোট ঘোষণার আগের দিন কেন ওই ভাবে ফাইলে সই করেছিলেনই বা কেন? গৌতমবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘আমি কী করে জানব কবে নির্বাচন ঘোষণা হবে? কমিশন কি আমার সঙ্গে আগাম আলোচনা করেছিল?’’ নিজের পক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তা হলে ২৮ তারিখ তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত যে সব ফাইলে সই করেছিলেন, সেগুলিও বাতিল করা হোক! সরকারের সে ক্ষমতা আছে?’’ উত্তেজনা এবং হিডকো সংস্থার সঙ্গে জড়িত তাঁর আবেগ বশে রাখতে না পেরে এ দিন বেশ কয়েক বার শব্দপ্রয়োগেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন গৌতমবাবু। যেমন, সাংবাদিক সম্মেলনেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘মন্ত্রী কি বরাহনন্দন যে, চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর জমি-বণ্টনের কোনও ক্ষমতা থাকবে না? বাম সরকার চলে যাওয়ার সময়েও হিডকোর তহবিলে ১৭০০ কোটি টাকা নগদ রেখে গিয়েছিলাম!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE