Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দুর্নীতির দায়ে বেনজির বরখাস্ত কৃতী বিজ্ঞানী

একটা-দুটো নয়। বিশ্বভারতীয় সদ্য-বরখাস্ত হওয়া উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তর বিরুদ্ধে অভিযোগ ভূরি ভূরি। যদিও সুশান্তবাবু অতীতে বারবারই দাবি করেছেন, নিয়মবিরুদ্ধ কাজ তিনি করেননি।

অকাল হোলি। উপাচার্যের অপসারণের খবর পেয়ে উচ্ছ্বাস বিশ্বভারতীর কর্মী-শিক্ষকদের একাংশের। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

অকাল হোলি। উপাচার্যের অপসারণের খবর পেয়ে উচ্ছ্বাস বিশ্বভারতীর কর্মী-শিক্ষকদের একাংশের। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৪:১৮
Share: Save:

একটা-দুটো নয়। বিশ্বভারতীয় সদ্য-বরখাস্ত হওয়া উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তর বিরুদ্ধে অভিযোগ ভূরি ভূরি। যদিও সুশান্তবাবু অতীতে বারবারই দাবি করেছেন, নিয়মবিরুদ্ধ কাজ তিনি করেননি।

কী ধরনের অভিযোগ উঠেছিল সুশান্তবাবুর নামে? ইউজিসি-র নিয়মের বাইরে গিয়ে ‘কন্ট্রোলার অব এগজামিনেশন’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করা, পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের অধ্যক্ষদের বিনয় ভবনে বদলি করা, নিয়ম ভেঙে তিনটি ‘প্রোভস্ট’ পদে নিয়োগ করার মতো নিয়মতান্ত্রিক অভিযোগ ছিল। সুশান্তবাবুর বক্তব্য ছিল, তিনি নতুন পদ তৈরি করেননি। কাউকে কাউকে বাড়তি দায়িত্ব দিয়েছেন মাত্র। অধ্যক্ষদের বদলি প্রসঙ্গেও তাঁর মন্তব্য ছিল, “শিক্ষা দফতর (বিনয় ভবন)-এর সঙ্গে স্কুলগুলো (পাঠভবন ও শিক্ষাসত্র) যাতে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা।” এ ছাড়া উপাচার্য দাবি করেছিলেন, প্রত্যেকটি রদবদল এগজিকিউটিভ কমিটি অনুমোদন করেছিল। কিন্তু অন্তত ২৫টি নিয়োগে স্বজনপোষণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মীকে বেতন হিসাবে বাড়তি অর্থ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ছিল। নবনিযুক্তদের অধিকাংশের ইউজিসি নির্ধারিত আবশ্যিক যোগ্যতা ছিল না বলেও অভিযোগ।

গত বছর মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এ সব নিয়ে কারণ দর্শাতে বলেছিল সুশান্তকে। তাঁর উত্তর কিন্তু মন্ত্রককে সন্তুষ্ট করেনি। বরং সুশান্তর ব্যাপারে অতি বিরল রাজনৈতিক ঐকমত্যই দেখা গিয়েছে বারবার। সিপিএম-কংগ্রেস-তৃণমূল একযোগে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরব এবং কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের মনোভাবও অভিন্ন— এমনটা সম্ভব হয়েছে কেবল সুশান্তর বেলাতেই।

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লিঙ্গবৈষম্য এবং যৌন হয়রানির অভিযোগও আনেন মহিলা কর্মীদের একাংশ। গত অগস্ট মাসে তার রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় ইউজিসি। তার মধ্যেই আবার সিকিম থেকে আসা প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী যৌন হেনস্থার শিকার হন। অভিযোগ ওঠে, বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য সওয়াল করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যার জেরে শেষ পর্যন্ত পড়া ছেড়ে সিকিমে ফিরে যেতে বাধ্য হন ওই ছাত্রী। এ নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে একাধিক বার ঘনিষ্ঠ মহলে ক্ষোভ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।।

সব মিলিয়ে গত বছর থেকেই ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন উপাচার্য। অভ্যন্তরীণ কোটা বাতিল করতে চেয়ে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের লাগাতার বিক্ষোভে তাঁকে কার্যত হার মানতে হয়। সেই সঙ্গে ‘ন্যাক’-এর মূল্যায়নে ‘বি’ গ্রেড পাওয়ার হতাশা, এবং তাঁর নানা ‘অনিয়ম’-এর জেরে আদালতে মামলা লড়তে গিয়ে বিপুল খরচ, এ সবই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে একই সঙ্গে সুশান্তবাবুর বেতন ও আগের চাকরির পেনশন পাওয়া নিয়ে। অভিযোগ, তিনি উপাচার্য হিসাবে বিশ্বভারতী থেকে বেতন নেওয়ার পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেনশনও নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত খরচের বিল বিশ্বভারতীর টাকায় মেটানোর অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

সুশান্তর পাশে ছিলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরাও। তাদের একটি অংশের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নামেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত। ‘অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘প্রাক্তন’ সম্পাদক পুলক চক্রবর্তী সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে আর্থিক বেনিয়ম-সহ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ তুলে বিশ্বভারতীর পরিদর্শক তথা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে লিখিত ভাবে জানান। এ ছাড়া সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ এনে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেন আর এক প্রাক্তনী সুবোধ মিশ্র। প্রাক্তনীদের অভিযোগ, এই সব কর্মকাণ্ডে ক্ষিপ্ত হয়ে সুশান্তবাবু অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশনের দফতরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার প্রতিবাদে পৌষমেলা চলাকালীন পুলকবাবুরা আম্রকুঞ্জে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মৌনী মিছিল করেছিলেন বছর তিনেক আগে।

অথচ শিক্ষাবিদ-গবেষক হিসেবে সুশান্তবাবুর যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করে ১৯৭৩ সালে নিউ ইয়র্কের সেন্ট জনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি করেন তিনি। ’৭৭-এ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি থেকে ‘ইয়ং সায়েন্টিস্ট’ হিসাবে পদক পান। পেয়েছেন রাজা রমন, মেঘনাদ সাহা মেমোরিয়াল পদকের মতো সম্মান। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা ছাড়াও বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলাপক্কম পরমাণু কেন্দ্রে কাজ করা ছাড়াও কলকাতায় এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সের অধিকর্তা ছিলেন। সেখান থেকে নদিয়ার মোহনপুরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর অধিকর্তা হয়েছিলেন।

এমন কৃতী ব্যক্তিত্বকেই কিনা বেনজির ভাবে সরতে হল পদ থেকে! কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে মন্ত্রকের এমন পদক্ষেপ বিধিসম্মত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনে হস্তক্ষেপ বলেও কারও কারও মত। যদিও মন্ত্রকের যুক্তি, যে ভাবে সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ আসছিল, তার পরে হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE