Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিপন্ন পাখি

হাওড়া-হুগলির বড় বড় জলাশয়েও মিলছে না পরিযায়ীদের দেখা। বাড়ির ঘুলঘুলি থেকে বারান্দা— সেখানেও কমছে পাখির আনাগোনা। কিন্তু কেন? কারণ খুঁজল আনন্দবাজার।পরিবেশ এবং পাখিপ্রেমীদের মতে, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, রিষড়া, শ্রীরামপুরের মতো এলাকায় দ্রুত নগরায়নের ফলেই হারিয়ে যাচ্ছে পাখিরা। গত দেড়-দুই দশকে আমূল বদলে গিয়েছে হুগলির সব জায়গায় জীববৈচিত্র্য। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, একের পর এক জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে উঁচু উঁচু বাড়ি।

বন্দি: পুকুরে দেওয়া জালে আটকে পড়েছে মাছরাঙা। ছবি: সুব্রত জানা

বন্দি: পুকুরে দেওয়া জালে আটকে পড়েছে মাছরাঙা। ছবি: সুব্রত জানা

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:০৮
Share: Save:

দ্রুত কমেছে পাখির সংখ্যা।

পরিবেশ এবং পাখিপ্রেমীদের মতে, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, রিষড়া, শ্রীরামপুরের মতো এলাকায় দ্রুত নগরায়নের ফলেই হারিয়ে যাচ্ছে পাখিরা। গত দেড়-দুই দশকে আমূল বদলে গিয়েছে হুগলির সব জায়গায় জীববৈচিত্র্য। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, একের পর এক জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে উঁচু উঁচু বাড়ি। কাটা পড়েছে গাছ। আবাসনের ঘেরাটোপে চেনা ঠিকানা হারাচ্ছে পাখপাখালি। আবার বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রী সুবিধার নামে শেড তৈরি হচ্ছে বড় বড় পুরনো গাছ কেটে। পাখিরা হারাচ্ছে খাদ্য ও বাসস্থান— একই সঙ্গে।

আবার অভিযোগ, গ্রামাঞ্চলে একশ্রেণির মানুষ চোরাগোপ্তা বন্দুক দিয়েও পাখি মারেন। দিয়ারা, চণ্ডীত‌লা, হরিপাল, শিয়াখালা-সহ হুগলির নানা জায়গায় ফি-বছর শীতে পরিযায়ী পাখি আসে। এক বছর আগেও চণ্ডীতলার হরিপুরে খাবারে বিষ দিয়ে পরিযায়ী পাখি মারার অভিযোগ উঠেছিল। স্থানীয় পাখিপ্রেমীদের তরফে বিষয়টি থানায়, বন দফতরে জানানো হয়। সচেতনতা প্রচার চলে।

শিয়াখালার হরিরামবাটীর একটি জলাশয় দীর্ঘদিন‌ ধরেই পরিযায়ী পাখির ঠিকানা ছিল। এ বার সেখানে পাখি আসেনি। স্থানীয় সন্ধিপুর গ্রামের বাসিন্দা সুরজিৎ দাস বলেন, ‘‘ওরা শীতের অতিথি। এ বার কেন যে এল না!’’ সুরজিৎবাবু জানান, দু’-তিন বছর আগে মোটরবাইকে চেপে বন্দুক নিয়ে পাখি শিকারে এসেছিলেন কিছু লোক। দেখতে পেয়ে গ্রামবাসীরাই তাঁদের হঠিয়ে দেন। ডিজে বক্সের দৌরাত্ম্যেও পাখিরা স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছে না বলেও অনেকের ধারণা।

রাজ্যের জীববৈচিত্র্য পর্ষদের কর্তারাও পাখিদের বিপন্নতার কথা মানছেন। তাঁদের বক্তব্য, দ্রুত নগরায়ন, গ্রামগঞ্জে শিকারের ফলেই তৈরি হচ্ছে এই বিপন্নতা। ধান ওঠার পরে জমিতে জা‌ল পেতে পাখি ধরার চেষ্টা করেন এক শ্রেণির মানুষ। পর্ষদের হুগলি জেলার কো-অর্ডিনেটর মানিক পাল বলেন, ‘‘গাছ কেটে ফেলার কারণে পাখিদের খাদ্যাভ্যাস বদলে যাচ্ছে। মাদার, ফলসা গাছের ফল পাখিদের খুবই প্রিয়। কিন্তু এই সব গাছ এখন প্রায় দেখাই যায় না। তালগাছ কেটে ফেলায় বাবুই পাখি কমেছে। শকুন কার্যত উবে গিয়েছে। বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ানো শালিখ, চড়াই, টুনটুনিও শহরে আর দেখা যায় না।’’

মে মাসে কোথাও কোথাও চলে শিকার উৎসব। পাখিদের কাছে নতুন বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাছ চাষ। বিশেষ করে মাছরাঙা পাখিদের কাছে বড় সঙ্কট হয়ে দেখা দিয়েছেন মাছচাষিরা। তাঁরা মাছদের বাঁচাতে পুকুরটি ঢেকে দেন জাল দিয়ে। ফাঁদে পড়ে মৃত্যু হয় বহু মাছরাঙা পাখির। বিশেষ করে বাউড়িয়া, চেঙ্গাইল প্রভৃতি এলাকায় ঝিলে যাঁরা মাছ চাষ করেন তাঁদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামগঞ্জের অন্য পুকুরেও জালের ফাঁদ পাতা থাকে।

বাবুই পাখিদের ক্ষেত্রেও অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিয়েছে বহু জায়গায়। বিশেষ করে জগৎবল্লভপুরের বিভিন্ন এলাকায় চাষিরা বাবুই পাখির হাত থেকে ধানের গাছ বাঁচাতে ফাঁদ পাতেন। তাতে ধরা পড়ে মৃত্যু হয় বাবুই পাখিদের। কারণ, ধানগাছের পাতা তুলে নিয়ে এসে বাবুই পাখিরা বাসা বাঁধে। জগৎবল্লভপুরের বিভিন্ন এলাকায় ধান জমির পাশেই আছে খড়িবন। বাবুই পাখিরা ধান গাছের পাতা ছিড়ে এনে খড়িগাছে বাসা করে। চাষিরা ধানের ক্ষতি রুথকেই ফাঁদ পেতে পাখি ধরে ফেলেন বলে অভিযোগ। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই। ঝড়ে বড় গাছ ভেঙে পড়ে বহু পাখির বাসা ভেঙে যায়। মারা যায় বাচ্চারা। বছর দুই আগে ঝড়ে নিমদিঘিতে অনেকগুলি গাছ ভেঙে পড়েছিল। ৪০টি শামুখখোল, বক, পানকৌড়ির বাচ্চার মৃত্যু হয় একদিনেই। অভিযোগ, বন দফতর এইসব ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয় না। তাহলে আহত পাখিদের বাঁচানো যায়।

বন দফতরের কর্তাদের অবশ্য দাবি, তাঁরা পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে কড়া নজরদারি চালান। তার ফলেই সখের শিকারিদের আর দেখা মেলে না। গত বছর দু’জন বিরুদ্ধেও পাখি শিকারের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তাঁরা জানান। তাঁদের দাবি মাছ চাষি এবং ধান চাষিদেরও ফাঁদ পাতার বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে। বন দফতরের উলুবেড়িয়ার রেঞ্জ অফিসার উৎপল সরকার বলেন, ‘‘হাওড়া জেলায় পাখির সংখ্যা কমেনি। গ্রামবাসীরাও সচেতন। আমরা তাঁদের নিয়ে নিয়মিত শিবির করি যাতে পাখির ক্ষতি না করা হয়। এতে কাজও হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Deforestation Migratory Bird
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE