ডাক্তারের অভাবে গোটা বাংলা তো ভুগছেই। এমনকী ওষুধ বিক্রিতে নজরদারির জন্যও যথেষ্ট লোক নেই। অনলাইনে ওষুধ বিক্রিতে নজরদারিও মার খাচ্ছে লোকবলের অভাবে।
সব ওষুধ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে অনলাইন ফার্মাসির সুযোগ দিয়েছে ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া বা ডিসি়জিআই-এর অফিস। কিন্তু রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগ সেই প্রক্রিয়ার উপরে যথাযথ নজরদারি চালাতে পারছে না। অনলাইন ফার্মাসির সাহায্য নিয়ে মানুষ ঠকে যাচ্ছেন, এমন ভূরি ভূরি অভিযোগ আসায় ওই সব ফার্মাসিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কড়া বিধি প্রণয়নের কথা ভাবছে ডিসি়জিআই। ওই দফতরের খবর, নয়া বিধিতে অনলাইন ফার্মাসিগুলির উপরে নিরন্তর নজরদরি চালানোর কথা বলা হচ্ছে। এটা জেনেই রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল পড়েছে আতান্তরে।
রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের এক কর্তা স্বীকার করে নিয়েছেন, রাজ্য জুড়ে ওষুধের দোকানগুলিতে যতটা নজরদারি এবং নিয়মিত অভিযান চালানো উচিত, তার সিকিভাগও তাঁরা করে উঠতে পারেন না। ‘‘এর উপরে অনলাইন ফার্মাসিগুলির কাজকর্মে নজর রাখতে হলে আর দেখতে হবে না! আমাদের শাঁখের করাতের মতো অবস্থা,’’ বলছেন ওই কর্তা। কেন? ড্রাগ কন্ট্রোলের ওই কর্তা জানাচ্ছেন, দু’টো কাজ চালানোর মতো লোকবল তাঁদের নেই। এই অবস্থায় অনলাইন ফার্মাসির উপরে নজরদারি চালাতে দেলে ওষুধের দোকানে দোকানে এখন যতটুকু অভিযান হয়, সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিপণন সংস্থা অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বিক্রি করছে। সুকান্ত সর্দার বা পঙ্কজ শর্মার মতো এমনই কিছু সংস্থার কর্তা জানান, কোনও ক্রেতা অনলাইনে তাঁদের ওয়েবসাইটে ক্যানসার, অনিদ্রা, মানসিক রোগ, যক্ষ্মা-সহ বেশ কিছু অসুখের ওষুধের বরাত দিলেই তা তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এই ওষুধ যাচ্ছে মূলত বিভিন্ন এলাকার খুচরো ওষুধ বিক্রেতার কাছ থেকে।
ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিক আইনে অনলাইনে ওষুধ বিক্রির নিয়মকানুন সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। কারণ ওই আইন যখন চালু হয়েছিল, তখন অনলাইন ফার্মাসিই ছিল না। সপ্তাহ দেড়েক আগে দিল্লিতে সব রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলারদের নিয়ে ৪৮তম ড্রাগস কনসালটেটিভ কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে অনলাইন ফার্মাসিগুলির জন্য নির্দেশিকা তৈরি করার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। সেই অনুযায়ী মুম্বই, দিল্লি, কর্নাটক, ওড়িশার ড্রাগ কন্ট্রোলারদের নিয়ে গড়া হয় একটি সাব-কমিটি। চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে অনলাইন ফার্মাসির জন্য নির্দেশিকা তৈরি করবে তারা।
কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল জ্ঞানেন্দ্র সিংহের মতে, অনলাইন ফার্মাসিগুলি অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক, নেশা হতে পারে এমন ওষুধ এবং যক্ষ্মার ওষুধও দেওয়া হচ্ছে। তাই ওষুধ বিক্রির এই ব্যবস্থায় নজরদারি দরকার। জ্ঞানেন্দ্র বলছেন, ‘‘অনলাইন ওষুধ বিক্রির নির্দেশিকা তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত সব রাজ্যেই অনলাইন ফার্মাসির কাজকর্ম নীতিগত ভাবে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যদি তা না-ও হয়, সে-ক্ষেত্রে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলগুলিকে ওই সব ফার্মাসির কাজের উপরে লাগাতার নজরদারি চালাতে বলা হবে।’’
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর কী করবে?
কী যে করা যাবে, ভেবে কূল পাচ্ছেন না রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। কারণ লোকাভাব প্রচণ্ড। অনেক পরিদর্শক-পদই খালি। পশ্চিমবঙ্গের ড্রাগ কন্ট্রোলের এক কর্তার কথায়, ‘‘গোটা রাজ্যে এখন ড্রাগ ইনস্পেক্টর আছেন মাত্র ৫১ জন। খালি পদের সংখ্যা ৮৯। এই পরিকাঠামোয় ৯৯ শতাংশ ওষুধের দোকানেই নজর রাখা যায় না। অনলাইন ফার্মাসিতে নজর রাখা যাবে কী ভাবে!’’
এই অবস্থা কেন?
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ২০০৫ সালের পরে পশ্চিমবঙ্গে কোনও ড্রাগ ইনস্পেক্টর নিয়োগ করা হয়নি। হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড মাস তিনেক আগে ইনস্পেক্টর নিয়োগের তোড়জোড় শুরু করেছে। যদিও এ ব্যাপারে এখনও কোনও বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে নজরদারি চালাতে যে সমস্যা হবে, তা মেনে নিচ্ছেন রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলার চিন্তামণি ঘোষও। তিনি বলেন, ‘‘অসুবিধা হবে। তবে লোকাভাবের সমস্যা বেশি দিন স্থায়ী হবে না। চলতি মাসেই ড্রাগ ইনস্পেক্টর নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেব আমরা।’’
তবে ড্রাগ কন্ট্রোলেরই অন্য এক কর্তার মতে, নজরদারির কাজটা মোটেই সহজ নয়। প্রথমত, ড্রাগ আইন অনুযায়ী খুচরো বিক্রেতারা কারও বাড়ি গিয়ে ওষুধ বিক্রি করতে পারে না। অথচ অনলাইন ওষুধ বিক্রির অনেক সংস্থাই আঞ্চলিক ভাবে ক্রেতার বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্থানীয় খুচরো বিক্রেতাদের সাহায্য নিচ্ছেন। কিন্তু ওই সব বিক্রেতা সম্পর্কে কোনও তথ্য তারা ড্রাগ কন্ট্রোলে জানায় না।
অনলাইন ওষুধ বিক্রিতে নজর রাখার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা ব্যাখ্যা করেছেন ড্রাগ কন্ট্রোলের এক কর্তা। তিনি জানান, প্রথমত, ওষুধ কিনতে চেয়ে ক্রেতারা অনলাইনে যে-প্রেসক্রিপশনের স্ক্যান করা প্রতিলিপি জমা দিচ্ছেন, সেটি আসল কি না দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুরনো প্রেসক্রিপশনের তারিখ বদলে দিয়ে তার ফোটোকপি করেও অনেকে অনলাইনে পাঠাতে পারেন। অর্থাৎ প্রেসক্রিপশন ঠিক হলেই হবে না। সেটির তারিখ যাচাই করাও জরুরি। তৃতীয়ত, অনলাইনে ওষুধ কেনার জন্য ক্রেতা যে-চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন জমা দিচ্ছেন, সেই চিকিৎসকের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না, তা-ও যাচাই করতে হবে।
লোকবল না-বাড়ালে এত সব কাজ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তা-কর্মীদের বড় একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy