Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সন্ত্রাসের স্মৃতিই সঙ্গী আজ

মমতার শান্তি-নিদান, আশঙ্কায় বিরোধীরা

বিস্তর অনিয়ম, বুথ দখল, গা-জোয়ারির অভিযোগের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল কলকাতার পুরভোট। ঠিক এক সপ্তাহ আগে। সেই ভোটের স্মৃতি তাজা রেখেই আজ, শনিবার নির্বাচন আরও ৯১টি পুরসভায়। সেখানে কলকাতার ভোট-চিত্রের পুনরাবৃত্তি হবে কি না, সেটাই প্রধান কৌতূহল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য কলকাতার ভোটে কোনও অশান্তি দেখেননি।

ভোটের আগে বাহিনীর টহল। শুক্রবার বারুইপুরে। — নিজস্ব চিত্র।

ভোটের আগে বাহিনীর টহল। শুক্রবার বারুইপুরে। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫০
Share: Save:

বিস্তর অনিয়ম, বুথ দখল, গা-জোয়ারির অভিযোগের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছিল কলকাতার পুরভোট। ঠিক এক সপ্তাহ আগে। সেই ভোটের স্মৃতি তাজা রেখেই আজ, শনিবার নির্বাচন আরও ৯১টি পুরসভায়। সেখানে কলকাতার ভোট-চিত্রের পুনরাবৃত্তি হবে কি না, সেটাই প্রধান কৌতূহল।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য কলকাতার ভোটে কোনও অশান্তি দেখেননি। এ দিনও নবান্নে তিনি বলেছেন, ‘‘কলকাতা পুলিশ এবং আমার প্রশাসন খুব ভাল কাজ করেছে। এটার জন্য কারও কাছে জ্ঞান নেওয়ার প্রয়োজন নেই!’’ একই সঙ্গে আজকের ভোট নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘গণদেবতাকে আমি বিশ্বাস করি, ভরসা করি। তাই কত আসন পাব, আমি কিছু বলব না। তবে আগামী কালের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে।’’

এখানেই অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন বিরোধীরা! তাঁদের বক্তব্য, কলকাতার পুরভোটে পুলিশ ছিল কার্যত নীরব দর্শক। ভোট-লুঠে তারা বাধা দিতে তো পারেইনি, উল্টে ভোট শেষের পরে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এক পুলিশ-কর্মী। যে ঘটনায় অভিযোগ উঠেছিল শাসক দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দিকেই। কিন্তু পরিচয় পর্যন্ত জানাতে পারেনি পুলিশ। এই প্রেক্ষিত মনে রাখলে মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্য অনেকটা সেই ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’ গোছের! তিনি প্রশাসনকে বার্তা দিয়ে রাখলেন, তারা কলকাতায় যেমন ভাবে কাজ করেছিল, তেমন ভাবেই করবে। চার পাশে যা ঘটবে, সব ‘শান্তিপূর্ণ’ বলেই ধরে নিতে হবে! বলছেন বিরোধীরা।

নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুক্রবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।

কলকাতার মতো শহরে যেখানে অতি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছনো সম্ভব, সেখানে যখন প্রশাসন এবং কমিশন কাঙ্খিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি, তখন জেলার ভোটে অন্য কিছু আশা করা যায় কী ভাবে— উঠে আসছে এই প্রশ্নও।

কলকাতার উপকণ্ঠে উত্তর ২৪ পরগনায় এ বার সর্বাধিক ২৩টি পুরসভায় ভোট। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বাকি পুরসভাগুলি। তার মধ্যে আলাদা করে নজর থাকবে শিলিগুড়ির দিকে। যেখানে বামেদের হাতে পুরবোর্ডের অধিকার ফেরাতে সিপিএমের সেনাপতি হয়েছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। এবং বামেদের পুনরুজ্জীবন আটকাতে সক্রিয় হয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। শিলিগুড়িতে বহিরাগত বাহিনী দিয়ে তৃণমূল গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছে বলে বামেদের অভিযোগ। একই অভিযোগ আসছে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়া, উত্তর ২৪ পরগনার মতো জেলা থেকেও। যে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘একতরফা অভিযোগ করা হচ্ছে! বাইরে থেকে নাকি বর্গি আসছে! এখানে কি কোনও সরকার নেই?’’ যেখানে যা অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

ভোটে অশান্তির আশঙ্কা করে সিপিএম এবং বিজেপি এ দিনই দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর। পরে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, ‘‘উনি (মুখ্যমন্ত্রী) পুলিশকে ম্যান অব দ্য ম্যাচ আখ্যা দিয়েছেন। মানে কলকাতার পুরভোটের দিন উনি যে ম্যাচ খেলেছেন, সেই ম্যাচের! পুলিশ ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছে বলে তাকে ট্রফি দিয়েছেন বুলেট!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের নেতৃত্বে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, জয় বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ৪২ জনের একটি দলও এ দিন রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে। পরে রাহুলবাবু বলেন, ‘‘কংগ্রেস, সিপিএম-সহ বিরোধী দলের কাছে আবেদন করছি, সন্ত্রাস-রিগিং হলে একযোগে মোকাবিলা করুন!’’

বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন

সন্ত্রাসের এই আশঙ্কার পিছনে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন এবং সব জেতার খিদেকেই দায়ী করছেন বিরোধীরা। বছরখানেক আগের লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে রাজ্যের বহু পুরসভাতেই তৃণমূল এগিয়ে। মাত্র কয়েকটি পুরসভায় এবং কিছু পকেটে ধাক্কা খেয়েছিল তারা। কিন্তু তার পরেও সব পুরসভা ‘বিরোধীশূন্য’ করে জেতার তাগিদ থেকেই অশান্তি বাধছে বলে অভিযোগ।

শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ অবশ্য জবরদস্তি করে ভোট চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন, এক বার এই পথে ঢুকে পড়লে আর বেরোনো কঠিন! স্বাভাবিক ভাবে ভোট করতে দিলে যেখানে তৃণমূল জিতত, সেখানে বলপ্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। যা আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগে মোটেই ভাল সঙ্কেত নয়। এমনই এক নেতার বক্তব্য, ‘‘বিনা রক্তপাতেও খুন করা যায়! গলা টিপে শ্বাস রোধ করে মারা যায়। আবার বিষ খাইয়েও খুন করা যায়! তাই বিশেষ রক্তপাত না হলে সন্ত্রাস হয়নি, এটা বলা যায় না!’’ কিন্তু তৃণমূলের সংগঠনে উপর তলার সেই নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নিচু তলার বাহিনীর কাছে সেই বার্তা পৌঁছচ্ছে না।

আর দ্বিতীয়ত, কলকাতার চেয়ে বাইরের পুরসভাগুলিতে আরও বেশি সংখ্যায় শাসক দলের বিক্ষুব্ধ লোকজন নির্দল বা গোঁজ প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন। নির্দলদের সঙ্গে মূল তৃণমূলের টক্কর বহু জায়গায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলছে। বিক্ষুব্ধদের পিছনে বহু জায়গায় মুকুল রায়ের ছায়া দেখছে দলের একাংশ। মুকুল চাইছেন, যত বেশি সংখ্যক কাউন্সিলর নিজের হাতে রাখতে। আর তাঁর ওই পরিকল্পনা আছে ধরে নিয়েই তা বানচাল করতে মরিয়া দলের একাংশ! এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘আমাদের তো বিরোধীদের নিয়ে চিন্তা নেই। চিন্তা তৃণমূল বনাম তৃণমূলের লড়াই!’’ আর এই আশঙ্কা থেকেই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর লোকজন যাতে গোলমাল করতে না পারে, সে জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে।

তৃণমূলের এক সূত্রের অবশ্য দাবি, কোনও দলীয় রং না-দেখেই পুলিশ-প্রশাসনকে সক্রিয় হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানাচ্চেন, মুখ্যমন্ত্রী এ দিনই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দুই তৃণমূল নেতাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গোলমাল দেখলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন

পুলিশের পাশাপাশি আজ ৩১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীও থাকছে। এ দিন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়কে ফোন করে বাহিনী পাওয়ার খবর জানান স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধায়। ভোটের দিন টহলদারির কাজে ওই বাহিনীকে লাগানো যাবে। সুশান্তবাবু জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীর কিছু অংশকে উত্তর ২৪ পরগনা ও শিলিগুড়িতে মোতায়েন করতে বলেছেন তিনি। বাহিনী থাকবে দুই দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়াতেও। নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, আধাসেনা পাওয়া যাবে না বলে কেন্দ্র জানিয়ে দেওয়ার পরে তিনি নিজে থেকে আর বাহিনী চেয়ে কোথাও দরবার করেননি। তা হলে ভোটের আগের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে এল? সুশান্তবাবুর বক্তব্য, ‘‘এটা হতেই পারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এক সময় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পরে মন্ত্রীর নির্দেশে তা পুনর্বিবেচনা করেছেন। তবে বলতে পারি, এটা ভালই হল!’’

বিরোধীরা অবশ্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভরসায় নেই। সূর্যবাবু যেমন বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, শিলিগুড়ি তাঁর চাই। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীও সঙ্গে সঙ্গে আধিকারিকদের ওই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেছেন, দিনহাটা তাঁর চাই। এই রকম ওঁদের সকলেরই সোনার হরিণ চাই! তাই ওঁরা কী করতে পারেন, বোঝাই যাচ্ছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE