Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অম্বলের রোগীরও ভর্তি দরকার! তাই শয্যা পান না মুমূর্ষু

যে রোগীর প্রেসক্রিপশনে সাকুল্যে অ্যান্টাসি়ড আর ভিটামিন ছাড়া আর কিছু নেই, তাঁর জন্যও তড়িঘড়ি শয্যার ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে। আর মুমূর্ষু রোগী ফিরে যাচ্ছেন শয্যা না পেয়ে। যে সে হাসপাতাল নয়, রাজ্যের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমে এটাই প্রতি দিনের ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৬ ০২:০১
Share: Save:

যে রোগীর প্রেসক্রিপশনে সাকুল্যে অ্যান্টাসি়ড আর ভিটামিন ছাড়া আর কিছু নেই, তাঁর জন্যও তড়িঘড়ি শয্যার ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে। আর মুমূর্ষু রোগী ফিরে যাচ্ছেন শয্যা না পেয়ে। যে সে হাসপাতাল নয়, রাজ্যের একমাত্র সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমে এটাই প্রতি দিনের ছবি। অনুসন্ধান করে দেখা গেল, শয্যার এই অভাব বেশ কিছু ক্ষেত্রেই কৃত্রিম। আগাম ‘বেড বুকিং’-এর প্রবণতাই শয্যা নিয়ে হাহাকার তৈরি করছে এই হাসপাতালে। কারা সেই শয্যা বুক করে রাখছেন? রাখছেন খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই।

দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে ডেপুটি সুপার, সহকারী সুপারেরা বেশ কিছু শয্যা সকালেই ‘বুক’ করে রাখেন। কখনও সেগুলি কাজে লাগে, কখনও লাগে না। কিন্তু ওই আগাম বুকিংয়ের কারণে চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যেতে হয় বহু মুমূর্ষু রোগীকে। হয়তো কোনও রোগী এসে শয্যা পেলেন না। তাঁকে বলা হল, ‘কিচ্ছু খালি নেই।’ অথচ চোখের সামনে পরিজনেরা দেখলেন, বেড-ট্রলি খালি পড়ে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ে রোগীর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের গোলমাল, হাতাহাতিও বাধে। আসলে হয়তো সেই শয্যাগুলি কর্তৃপক্ষের তরফে কেউ বুক করে রেখেছেন! সেই বুক করে রাখা শয্যায় যাঁরা ভর্তি হন, সব সময়ে তাঁদের অসুস্থতাও যে খুব গুরুতর, এমন একেবারেই নয়। এ নিয়ে একাধিক বার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন নার্সরা। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। দিন কয়েক আগে এ নিয়ে বড়সড় গোলমাল বাধে। ইমার্জেন্সির ডাক্তার যে রোগিণীকে ‘ভর্তি করার প্রয়োজন নেই’ বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেই রোগিণীকেই তড়িঘড়ি ভর্তি করার চাপ আসে সুপারের দফতর থেকে। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের নার্সরা জানিয়ে দেন, কোনও শয্যাই খালি নেই। কিন্তু সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে তৎক্ষণাৎ শয্যার ব্যবস্থা করার হুকুম আসে। অন্য একটি ওয়ার্ডে কর্তৃপক্ষের বুক করে রাখা শয্যায় ভর্তির ব্যবস্থা হয়েও যায়। কিন্তু ভর্তির পর অ্যান্টাসিড এবং ভিটামিন ক্যাপসুল ছাড়া ওই রোগিণীকে কোনও ওষুধ দেওয়ারই প্রয়োজন পড়েনি। পরদিন সকালে তাঁকে ছেড়েও দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে সেই দিনই শয্যা না পেয়ে ওই ওয়ার্ড থেকে ফেরানো হয়েছিল এক মুমূর্ষু রোগীকে। অন্য হাসপাতালের দিকে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।

নার্সদের বক্তব্য, জেনে বা না জেনে এমন বহু দুর্ঘটনার দায় তাঁদের উপরে এসে পড়ে। অথচ এর সঙ্গে তাঁরা কোনও ভাবেই যুক্ত নন। মেডিসিন ওয়ার্ডের এক নার্স বলেন, ‘‘সুপার, ডেপুটি সুপার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার-সকলেই সকালের দিকে বেশ কিছু শয্যা আগাম বুকিং করে রাখেন। পরে হয়তো সেই শয্যাগুলি কাজেই লাগল না। খালি রইল। কিন্তু যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা পেলেন না।

তাঁদের বক্তব্য, কর্তৃপক্ষ আগাম ‘বেড বুকিং’ করে রাখার কারণেই হাসপাতালে শয্যার ‘কৃত্রিম’ অভাব তৈরি হচ্ছে। অবিলম্বে শয্যা আটকে রাখার এই বন্দোবস্ত বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা। প্রয়োজনে এই আন্দোলন এসএসকেএম থেকে অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

বিভিন্ন বিভাগের ইউনিটগুলির জন্য আলাদা করে শয্যা ভাগ করে রাখার জন্যও সমস্যা হয়। হয়তো ইউনিট ১-এ শয্যা নেই, রোগী ফিরে যাচ্ছে। আর ইউনিট ২-এ চার-পাঁচটি শয্যা খালি। ভাগাভাগি না থাকলে ওই শয্যাগুলিতে রোগীদের ঠাঁই দেওয়া যেত।’’ শয্যা বন্টনের ব্যবস্থা ঢেলে সাজার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন তাঁরা। শয্যা আটকে রাখার ক্ষেত্রে যে ক’জনের নাম তাঁরা সামনে এনেছেন, তার শীর্ষেই রয়েছেন হাসপাতালের ডেপুটি সুপার অতীন্দ্রনাথ মণ্ডল।

এ বিষয়ে অতীনবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘আমি কিছু জানি না।’’ কিন্তু তাঁর সম্পর্কেই তো বেড বুকিং-এর মূল অভিযোগ? তাঁর জবাব, ‘‘যা রটেছে সব ভুল। এর বেশি কিছু বলার নেই।’’ এ প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ হাসপাতালের অন্য কর্তাদেরও। হাসপাতালের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘আমাদেরও হাত-পা বাঁধা। রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী সহ অন্য ভিআইপিদের অনুরোধের চাপে আমরা জেরবার। ভর্তি না নিলে উপর মহল থেকেও চাপ আসে। বেড বুকিং রুখতে গেলে তাই গোড়ার গলদটা সারানো জরুরি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sskm negligence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE