Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আর কত দিন রসের বিনোদি

বছরের পর বছর ধরে এই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হত মন্দিরতলায়। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর দশমীতে। বিনোদিদের নাচাতেন বোরহান। বোরহানের পরে রুস্তম, রমেশ।

পুতুল নিয়ে রমেশ। নিজস্ব চিত্র

পুতুল নিয়ে রমেশ। নিজস্ব চিত্র

দীপক দাস
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:২১
Share: Save:

আঙুলের ইশারায় ঘাড়টা এক পাক ঘুরিয়ে নেয় বিনোদি। রসের বিনোদি। পাকা নর্তকীর মতো। নাচের হিল্লোল ওঠে ঘাগরা বাঁধা শরীরে। মাথায় বাঁধা ঝুমঝুমি বাজে ঝনঝন করে। দু’হাতে নাচের ভঙ্গিতে তালি দিয়ে ওঠে বিনোদি। এক জন নয়, দুই রসের বিনোদি। তখনই একটানে গেয়ে ওঠে বিনোদিকে নাচানো পুরুষটি, ‘সখি, নাচবি খেঁদি রসের বিনোদি...’।

দশমীর বেলা। বাবুর বাড়ির দুর্গাদালানের সামনে ভিড় জমেছে। ভিড়টা অসম্পূর্ণ একটা বৃত্ত তৈরি করেছে। সামনের সারিতে পাড়ার কাচ্চাবাচ্চারা। তার পরের সারিতে বড়রা। বাবুর বাড়ির শরিক আর আত্মীয়েরা পুজোর দালানে বসে। সেদিকটাতেই ভিড়ের বৃত্ত অসম্পূর্ণ। বাবুর বাড়ির লোকজনের সামনেই নাচ দেখাচ্ছে দুই বিনোদি, ভিড়ের ভাবটা এমনই।

বছরের পর বছর ধরে এই দৃশ্যের পুনরাভিনয় হত মন্দিরতলায়। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর দশমীতে। বিনোদিদের নাচাতেন বোরহান। বোরহানের পরে রুস্তম, রমেশ। রমেশরা পাতিহাল গ্রামের সাপুড়িয়া মাল। সাপ ধরা, সেই সাপের খেলা দেখানো তাঁদের বংশগত কাজ। আর সাপ খেলা দেখানোর প্রস্তাবনা অংশে আসর জমাতে দেখাতে হয় রসের বিনোদিদের নাচ। দুই পুতুল। আবক্ষ। শরীরের বাকি অংশটা পূরণ করেছে রংবেরঙের ঘাগরা। সুন্দর করে আঁকা চোখ। মাথায় বাঁধা একগুচ্ছ ঝুমঝুমি। বিনোদিদের লটক-মটকে ঝুমঝুমিতে আওয়াজ ওঠে। লটক-মটকের সবটাই রমেশদের আঙুলের ইশারায়। বিনোদিদের ফাঁপা দুই হাত আর মাথায় ঢুকে যায় মালিকের আঙুল। আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে রমেশরা পরিচয় দেন, বিনোদিরা আসলে দুই সতীন। তার পর গান ধরেন, ‘দুই সতীনে ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে’। গানে কোনও যুক্তির পারম্পর্য থাকে না। শুধুই বিনোদন, বিনোদন আর বিনোদন।

হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর ব্লকের গ্রাম পাতিহাল। গ্রামের হাটতলার কাছে রমেশদের বাড়ি। একটা পাড়া। সরকারি খাতায় মালপাড়া। এ পাড়ার লোকেরা পুতুল নাচ, সাপ খেলা ছাড়াও বাজি তৈরি করতে পারেন। পালাপার্বণে বাজি তৈরি করে এলাকার অভিজাত পরিবারগুলোকে সরবরাহ করাই পেশা। আর দশমীর দিন জমিদার বাড়ির দুর্গাদালানে সাপ খেলা দেখানো কাজ। সাপ খেলা দেখানো শেষ হলে পেতেন খই, চিড়ে, মুড়কি, পুরনো জামাকাপড় আর টাকা।

কবে থেকে শুরু এই সব? বিনোদিরা এল কোথা থেকে? ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকেন রমেশ। তার পর মাথা নেড়ে বলেন, ‘‘সে সব কী আর মনে থাকে!’’ শুধু মনে পড়ে, বাবা বোরহানের সঙ্গে ছোটবেলায় যেতেন দশমীর দিনে। তখন জমিদারি যুগ শেষ। জমিদারেরাও কলকাতাবাসী। পুজোর সময়ে আসতেন তাঁদের কেউ কেউ। দান-দক্ষিণা, খেলা, আমোদে ভরে থাকত দুর্গাদালান। বাবা মারা যাওয়ার পরে দাদা রুস্তম আর রমেশ খেলা দেখাতে যেতেন। পাড়ায় ঢোকার আগে রমেশদের ডুগডুগি বেজে উঠত, ডুগ...ডুগ...ডুগ...ডুগ। সেই আওয়াজে বাচ্চারা পয়সা চাইত বড়দের কাছে। খেলা শেষ হলে দেবে। বড়রা পকেটে খুচরো নিয়ে হাঁটা দিতেন মন্দিরতলায়। পাড়ার মেয়ে-বউদের হাত ব্যস্ত। দ্রুত হাতের কাজ শেষ করতে হবে।

আর এখন? দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রমেশ। দাদা রুস্তম মারা গিয়েছেন। পুতুল নাচ দেখানোর ভাল ওস্তাদ এখন তিনিই। ভাই গোপালও খেলা দেখান। এখন আর সাপের ঝাঁপি, বিনোদিদের নিয়ে বেশি বেরতে পারেন না রমেশ। বয়স হয়েছে। মাঝে পা ভেঙেছিল। হাঁটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে পুরনো নেশা জেগে ওঠে। পাড়ার দু’একজনকে নিয়ে বেরোন, ভ্যানে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাপ দেখিয়ে দক্ষিণা নেন। আক্ষেপ করেন রমেশ, ‘‘এখন কে দেখে সাপ খেলা! আর খেলা দেখাবেটা কে? সাপ খেলা দেখালে তো পুতুল নাচ দেখানো।’’

কেন এই হাল? সে কথা বলছিলেন বাপি মাল। পাড়ার প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। এখনও সেই শিক্ষাগত যোগ্যতা টপকাতে পারেননি তাঁদের পাড়ার কেউ। বললেন, ‘‘নতুন কেউ এই পেশায় আসতে চাইছে না। কেউ গাছ ছাড়ানোর কাজ করে, কেউ গাড়ি চালায়, কেউ দিনমজুরি করে। আগে বাজি তৈরি করে দু’পয়সা আয় হত। এখন প্রশাসনের কড়াকড়িতে তা-ও প্রায় বন্ধ। পাড়ায় ঢুকলেই বুঝতে পারা যাবে আমাদের কী কী দরকার।’’ বাপি এখন হাটে কাপড়ের কাজ করেন। বললেন, ‘‘ইদের পর থেকে বাজার ডাউন। অন্য কাজ করে সংসার চালাতে হিমসিম। পুতুল নাচ, সাপ খেলায় ক’পয়সা হবে!’’

পয়সা নেই বলে বিনোদিদের রূপচর্চা করা হয় না। হলুদ মুখে কালো কালো ছোপ। এক বিনোদির হাত ভেঙেছে। মলিন ঘাগরার রং। ছিঁড়েও গিয়েছে জায়গায় জায়গায়। খুলে পড়ছে ঝুমঝুমিগুলো। নতুন লোক আসে না বলে নতুন গান বাঁধা হয় না। আগে তবু হাল ফ্যাশনের সন্ধান মিলত বিনোদিদের সজ্জায়। এলাকায় চালু হল রাজ্য সরকারের বাস। বিনোদিরা দুই সতীন তখন পরতে শুরু করেছে বড় বড় টিপ। তা দেখে রমেশরা গেয়ে উঠলেন, ‘‘মনোমোহিনী টিপ পরেছে যেন এসটেট বাসের চাকা’।

আর যান বাবুর বাড়িতে খেলা দেখাতে? রমেশ ঘাড় নাড়েন। দীর্ঘশ্বাসের আভাস। সেই জৌলুস নেই। পুজো হয় টিমটিমিয়ে। গত বছর দশমীতে গিয়ে দেখেন দুর্গাদালান শূন্য।

ডুগডুগির শব্দে কেউ জড়ো হননি। ফিরেই আসছিলেন। থামিয়েছিলেন পাড়ার কয়েক জন। বলেন, ‘‘এসেছ যখন খেলা চালু করো। পয়সা দেব।’’

বৃদ্ধ বিনোদিদের আঙুলে গলিয়ে গান ধরেছিলেন মালেদের পুতুল নাচের শেষ উত্তরাধিকারীদের এক জন,

‘সখি, নাচবি খেঁদি রসের বিনোদি...’।

না, দুর্গা দালানের সামনে খেলা দেখাননি রমেশরা। দেখিয়েছিলেন নতুন গড়ে ওঠা কালীমন্দিরের সামনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Binodi Entertainment Durga Puja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE