Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রঞ্জিত-ঝর্নার আত্মসমর্পণে মন্ত্রীর হাতযশ

প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন, বুধবার দুপুরে স্ত্রী এবং অটোমেটিক রাইফেল-সহ সেই সবে আত্মসমর্পণ করেছেন মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পাল।

রঞ্জিত পাল

রঞ্জিত পাল

সুরবেক বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৬
Share: Save:

প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন, বুধবার দুপুরে স্ত্রী এবং অটোমেটিক রাইফেল-সহ সেই সবে আত্মসমর্পণ করেছেন মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পাল।

‘‘আমরা এখন অনেক নিশ্চিন্ত। মাওবাদীদের এই এক জনই হাতে আসা বাকি ছিল, যে হাতের তেলোর মতো জঙ্গলের রাস্তা, গ্রাম চেনে। তেমনই খুন করতে যার হাত কাঁপে না,’’ আত্মসমর্পণ পর্বের ঘণ্টাখানেক পরে বলেন রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা। তাঁর স্বরে স্বস্তি স্পষ্ট।

রঞ্জিত ওরফে রাহুল যাতে ধরা দেন, সেই জন্য দেড় বছরে তিন বার ঝাঁপিয়েছিলেন রাজ্যের গোয়েন্দারা। কিন্তু কোনও বারই সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। তা হলে এ বার হল কী ভাবে?

এ ক্ষেত্রে রাজ্যের এক মন্ত্রীর বড় ভূমিকা দেখছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, রঞ্জিতের শ্বশুরবাড়ি তথা মাওবাদী নেত্রী ঝর্না গিরি ওরফে অনিতার বাপের বাড়ির লোকজনের মাধ্যমে ওই মন্ত্রীর আশ্বাস রঞ্জিতের কাছে পৌঁছয় যে, ধরা দিলে সুচিত্রা মাহাতো-জাগরী বাস্কেদের মতো তিনিও সুযোগ-সুবিধে পাবেন। এবং রাজ্য সরকার বা পুলিশ তাঁর প্রতি প্রতিহিংসামূলক মনোভাব নেবে না।

নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ায় ঝর্নার বাড়ি। সেই তল্লাটের সঙ্গে ওই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ঝর্না যে ২০০৭ থেকে গ্রামছাড়া এবং তার পরে কালেদিনে তিনি যে মাওবাদী স্কোয়াডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন, মন্ত্রীমশাই তা জানতেন।

রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘বড় মাপের মাওবাদী নেতানেত্রীরা ধরা দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু আমাদের আশ্বাস পেয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারা চায় রাজনৈতিক আশ্বাস ও বিশ্বাস। যেটা ওই মন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছে রঞ্জিত।’’

ঘনিষ্ঠ মহলে ওই মন্ত্রী জানাচ্ছেন, রঞ্জিতের আত্মসমর্পণে তিনি ভূমিকা নিতে পেরে খুশি। তাঁর বক্তব্য, শু‌ধু পুলিশি অভিযান চালিয়ে নয়, শান্তিপূর্ণ পথেও দমন করা যায় মাওবাদীদের। ঘনিষ্ঠ মহলে ওই মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘রঞ্জিত পালের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ ছিল ঝাড়খণ্ডে। তবে সে এখানে আত্মসমর্পণ করল। এতে এই রাজ্যের সরকারের উপরে ওর আস্থার ব্যাপারটা বেশ বোঝা যায়।’’

রঞ্জিত যাতে আত্মসমর্পণ করেন, গত অগস্টে এক বার সেই চেষ্টা চালিয়েছিল রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা আইবি। যোগাযোগের একটা মাধ্যমও তৈরি করা গিয়েছিল ওই মাওবাদী নেতার সঙ্গে। ‘লিঙ্কম্যান’ হিসেবে কাজ করছিলেন এক ব্যক্তি এবং প্রাথমিক ভাবে ২০ হাজার টাকাও দেওয়া হয় তাঁকে। তবে সেপ্টেম্বরে সেই ‘লিঙ্ক’ কেটে যায়। তার আগে, গত বছরের গোড়ায় ঝাড়খণ্ড পুলিশ এবং ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স একই চেষ্টা চালিয়েছিল। কাজ হয়নি। পরিস্থিতি বদলায় এ বছর।

জানুয়ারির গোড়ায় পূর্ব সিংহভূমে মাওবাদীদের গুরাবান্ধা স্কোয়াডের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড সুপাই টুডু ঝাড়খণ্ড পুলিশের গুলিতে নিহত হন। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, দামপাড়া স্কোয়াডের নেতা রঞ্জিতের কাছে খবর পৌঁছয়, সুপাইকে মারা হয়েছে ‘এনকাউন্টার’ বা ভুয়ো সংঘর্ষে। রঞ্জিতের ভয় ছিল, তাঁরও ওই পরিণতি হতে পারে। গ্রামে তো বটেই, জঙ্গলেও অবাধ চলাফেরা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তা ছাড়া নোট বাতিলের জেরে তোলা বাবদ আদায় করা দেড় কোটি টাকা তাঁকে ফেলে দিতে হয়। তার উপরে মহিলাদের প্রতি আপত্তিকর আসক্তির কারণে পটমদার অনেক গ্রামবাসী তাঁর উপরে খাপ্পা ছিলেন।

শুধু গ্রামবাসীদের বিরূপতা নয়। মহিলাদের প্রতি আচরণকে ঘিরে রঞ্জিত প্রশ্নের মুখে পড়ছিলেন নিজের সংগঠনেও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছিল। যেমন রাজেশ মুন্ডা নামে এক মাওবাদীকে জেরা করে জানা যায়, দলের বেলপাহাড়ির নেতা মদন মাহাতোর স্ত্রীকে অশ্লীল ইঙ্গিত করার দায়ে রঞ্জিতকে বাংলা-ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা বর্ডার রিজিওনাল কমিটি থেকে বহিষ্কার করে দামপাড়া স্কোয়াডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে প়ড়েছিলেন বাংলার ভূমিপুত্র ওই মাওবাদী।

শেষ পর্যন্ত রঞ্জিতের আত্মসমর্পণে সহায় হলেন বাংলারই এক মন্ত্রী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ranjeet Pal Jharna Giri Surrender
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE