Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পুলিশি অভিযান, তবু চিন্তায় বিরোধীরা

এক রাতে শুধু বর্ধমান জেলা থেকেই হাজার দেড়েককে গ্রেফতার, বোমা, গুলি, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার—কত কী! রবিবার রাতে রাজ্য পুলিশের এই অভিযান শুধু বর্ধমান নয়, চলেছে জেলায় জেলায়। হুগলি জেলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৭৯৭ জনকে, পূর্ব মেদিনীপুরে ৫১৪, নদিয়ায় ৪২৭, উত্তর দিনাজপুরে ২৭৫, কোচবিহারে ১৯১, মুর্শিদাবাদে সংখ্যাটা শ’দেড়েক।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

এক রাতে শুধু বর্ধমান জেলা থেকেই হাজার দেড়েককে গ্রেফতার, বোমা, গুলি, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার—কত কী! রবিবার রাতে রাজ্য পুলিশের এই অভিযান শুধু বর্ধমান নয়, চলেছে জেলায় জেলায়। হুগলি জেলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৭৯৭ জনকে, পূর্ব মেদিনীপুরে ৫১৪, নদিয়ায় ৪২৭, উত্তর দিনাজপুরে ২৭৫, কোচবিহারে ১৯১, মুর্শিদাবাদে সংখ্যাটা শ’দেড়েক। কমবেশি অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত হয়েছে প্রায় সব জেলাতেই। ভোটের কলকাতায় শাসক দলের বিরুদ্ধে ওঠা সন্ত্রাসের অভিযোগ মোকাবিলায় কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকায় অভিযুক্ত পুলিশের এই তৎপরতা এক সঙ্গে অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

বিরোধীদের একাংশ জানতে চান, নিষ্ক্রিয়তার জন্য ছিছিক্কার, না ভোটের দিন শাসক দলের মদতে পুষ্ট দুষ্কৃতীদের গুলিতে পুলিশকর্মীর জখম হওয়া— কীসে হুঁশ ফিরল পুলিশের! জখম সহকর্মীর জন্য বাহিনীর নিচুতলার একাংশে ক্ষোভ ছড়াচ্ছে আঁচ করেই এই তৎপরতা কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। আবার বিরোধীদের আর এক অংশের জিজ্ঞাসা, ‘‘এ ধরনের অভিযান পুরোপুরি লোক দেখানো নয়তো? পরে পুলিশ বলবে তারা ভোটের ‘আদর্শ পরিবেশ’ বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল?’’

রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু অবশ্য পুলিশের উপরে আদৌ রাস্থা রাখছেন না। তিনি সোমবার বলেছেন, ‘‘কলকাতায় ভোটের দিন শাসক দল পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ভোট করেছে ২৫ এপ্রিল (রাজ্যের ৯১টি পুরসভায় ভোটের দিন) মানুষকে ভয়ে রাখার জন্য। পুলিশের ভূমিকায় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। ২৫ তারিখ সন্ত্রাস হলে মানুষকেই রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করতে হবে।’’


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

আবার রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব জানিয়েছেন, কলকাতা পুরভোটের দিনের গোলমাল নিয়ে নালিশ এবং ২৫ তারিখ তার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর আর্জি জানাতে আজ, মঙ্গলবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় এবং শুক্রবার রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করবেন তাঁরা। যদিও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী বলেন, ‘‘সরকার তো বিরোধীদের কথায় চলবে না! বিরোধীরা কীসে সন্তুষ্ট হচ্ছে, তা দেখলে তো চলবে না! বিরোধীদের আগে ৪০ বছর সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হবে। তার পরে তারা কথা বলবে।’’

আলিপুরদুয়ার বাদে উত্তরবঙ্গের অন্য সব জেলাতেই ভোট রয়েছে এ বার। পুলিশ সূত্রের খবর, ভোটের দিন কলকাতায় পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তা চাইছেন রাজ্য পুলিশের একটি বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, এই অবস্থায় বিরোধীদের কাউকে কোনও অভিযোগে ধরা হলে পাল্টা অভিযোগ থাকলে শাসক দলের লোককেও ধরতে হবে। নিদেনপক্ষে, নির্দিষ্ট
ভাবে মামলা রুজু করে দিতে হবে। তাই জেলায় জেলায় শুরু হয়েছে ধরপাকড়। রবিবার উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ৮৫৭ জনকে। কোচবিহারের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব দাবি করেছেন, ‘‘বিশেষ অভিযান চলছে।’’

উত্তরবঙ্গের একমাত্র পুলিশ কমিশনারেট— শিলিগুড়ি। কমিশনারেটের এক কর্তা জানান, গোলমালের আশঙ্কা এড়াতে ২৪টি ওয়ার্ডে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তিনটি ফাঁড়ি এলাকায় ওসিদের কাজে নজর রাখতে সিনিয়র অফিসারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশনার মনোজ বর্মার আশ্বাস, ‘‘অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা সুষ্ঠু ভাবে ভোট-পর্ব মেটাতে বদ্ধ পরিকর।’’

ভোট ঘোষণার পর থেকেই শাসক দলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়, বিশেষ করে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। ১৪টি পুরসভায় ভোট হচ্ছে শিল্পাঞ্চলে। অভিযোগের সংখ্যা প্রায় ৮০। যার মধ্যে বেশির ভাগই হুমকি, প্রচারে বাধাদান, ফ্লেক্স ছেঁড়ার মতো ঘটনা। হালিশহর, ভাটপাড়া, কাঁচরাপাড়া, গারুলিয়া, নৈহাটি, উত্তর ব্যারাকপুর— অভিযোগ আসছে সব জায়গা থেকেই। বিরোধীদের বক্তব্য, হামলা হয়েছে আরও বেশি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ নিয়ে থানা-পুলিশ করার সাহস পাচ্ছেন না তাঁরা। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র এ দিন জানান, শনিবারের ভোটের জন্যে কলকাতা পুলিশ থেকে ৩,৭২০ জনের একটি দলকে মূলত উত্তর ২৪ পরগনা এবং ব্যারাকপুরে পাঠানো হবে।

কিন্তু পুলিশের এই আশ্বাসে চিঁড়ে ভিজছে না। বিরোধীরা টানছেন একের পরে এক উদাহরণ।

হালিশহর ও কাঁচরাপাড়ায় শাসক দলের লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের কর্মীদের হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ বিজেপি-র। পুলিশের টহলদার গাড়ি এলাকা ঘুরে বেরিয়ে গেলেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করে বিজেপি-র নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ, ‘‘অভিযান চালানোর বদলে নজরদারিটুকু ঠিকঠাক করতো পুলিশ! তাতেও অনেক কাজ হতো।’’

বিরোধীরা জানাচ্ছেন— নির্বাচনী প্রচারসভা থেকে সিউড়ি পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে। সিউড়ি থানায় ১১ এপ্রিল হওয়া ওই অভিযোগের তদন্ত করতে চেয়ে সিউড়ি আদালতে আবেদন করে পুলিশ। ১৫ এপ্রিল আদালত আবেদন মঞ্জুর করে। যদিও এখনও পর্যন্ত তদন্তের অগ্রগতি শত চেষ্টা করেও তাঁরা জানতে পারেননি বলে বিরোধীদের দাবি। অনুব্রতের বিরুদ্ধে সাঁইথিয়া থানায় বিজেপি-র এক প্রার্থীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের তদন্তেরও একই দশা বলেও দাবি তাঁদের। তবে জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত যতগুলি অভিযোগ হয়েছে, সেগুলির মধ্যে মারাত্মক কিছু উল্লেখ নেই। তবুও আমরা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।’’ আর খোদ অনুব্রতর মন্তব্য ‘‘এ সবকে আমরা গুরুত্বই দিচ্ছি না।’’


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের দু’টি ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী প্রত্যাহারে বাধ্য করা, বিজেপি নেতার বাড়িতে, সিপিএমের প্রাক্তন জেলা সম্পাদকের উপরে হামলার ঘটনায় থানায় অভিযোগ হলেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। পুলিশ সুপার শীশরাম ঝাঁঝারিয়া অবশ্য দাবি করেছেন, সব অভিযোগই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বাঁকুড়া জেলায় রবিবার ‘বিশেষ অভিযান’ চালিয়ে শ’দুয়েক লোককে ধরেও বিরোধীদের ভরসার জায়গায় পৌঁছতে পারেনি পুলিশ। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘পুলিশ যাদের ধরেছে, তাদের বেশির ভাগই পুর-এলাকার বাসিন্দা। সেই সব দুষ্কৃতীদের ফাঁক ভরাট করতে পঞ্চায়েত এলাকা থেকে অন্য সমাজ বিরোধীদের আমদানি করছে শাসক দল। পুলিশ ঠিকঠাক নজরদারি করলে বহিরাগতেরা এলাকায় দাপানোর সাহস পেত না!’’ অভিযোগ মানেনি পুলিশ বা তৃণমূল— কোনও পক্ষই।

বিজেপি-র বর্ধমান পূর্ব জেলা সভাপতি রাজীব ভৌমিকেরও অভিযোগ, ‘‘বর্ধমান জেলায় যে চারটি পুরসভায় ভোট হবে সেগুলির আশপাশে সব গ্রামীণ এলাকা। সেখান থেকে দুষ্কৃতীদের জড়ো করে ভোটের দিন সন্ত্রাস তৈরির চেষ্টায় রয়েছে শাসকদল।’’ আবার সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিকের কটাক্ষ, ‘‘আমরা যাদের দুষ্কৃতী বলে জানি, তারা তো চোখের সামনেই
ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’

এমনই সব সূত্র ধরে এ দিন বীরভূমের সাঁইথিয়ায় বিজেপি-র হয়ে রোড-শো করতে এসে রূপা গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘জেলার যে সব জয়গায় পুরভোট হবে, শাসকদল সেখানেও কলকাতার কায়দায় সন্ত্রাস চালাবে বলে আমার আশঙ্কা।’’ সিউড়িতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ভয় পেয়েছেন। তাই মস্তান ও পুলিশের ভরসায় ভোট করতে চাইছেন।’’ পুলিশকর্মীদের প্রতি অধীর বলেন, ‘‘আপনাদের কাছে দয়া চাইছি না, সমর্থন চাইছি না। আপনাদের কাছে একটাই চাওয়া, সংবিধানের দায়িত্ব পালন করুন। নিরপেক্ষ থাকুন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE