পালানোর সময় বার বার পথ বদলেছে মিরশাদ। শেষে কোথায় গিয়েছে, তা এখনও অজানা।
ছিল হাওয়ার বেগে। ‘অপারেশন’ শেষ করে ফিরেও গিয়েছে সে ভাবেই।
কিন্তু মিরশাদ এখন কোথায়?
পুলিশ দিশেহারা। হাওয়ায় ভাসছে নানা গল্প। ভাঙা রেকর্ডের মতো পুলিশ আউড়ে চলেছে, ‘‘মিরশাদের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি চলছে। ওকে আমরা ধরবই।’’
কিন্তু ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা পরেও সে অধরা।
মিরশাদ কি ম্যাজিক জানে? সে কি হাওয়ায় উবে গেল? নাকি মাটির নীচে তলিয়ে গেল?
বৃহস্পতিবার ডোমকলের রমনা শেখপাড়ার মোড় যা দেখেছিল তা শুধু গল্পে-সিনেমাতেই হয়। এখনও ভাবতে গেলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। তাঁরা বলছেন, ‘‘খুন-জখম এর আগেও অনেক দেখেছি মশাই। কিন্তু এমন কায়দা এই প্রথম দেখলাম।’’
এ দিন সকালে ধুলো উড়িয়ে একটি কালো মোটরবাইক এসে থেমেছিল রমনা শেখপাড়ার মোড়ে। বাইকে মিরশাদের সঙ্গে আরও দু’জন ছিল। মিরশাদ বসেছিল একেবারে পিছনে। সকলের মাথায় হেলমেট ছিল। সেই সময় চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ইয়ার আলি শেখ (৫২) ও আবেদুল ইসলাম (৪৭)।
নিহত ইয়ার আলির মা।
ভরা বাজারে বাইক থেকেই ছিটকে আসে একের পর এক গুলি। লুটিয়ে পড়েন ইয়ার ও আবেদুল দু’জনেই। বাজারের মধ্যে আচমকা এমন ঘটনায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান লোকজন। কী করবেন বোঝার আগেই মাথা থেকে হেলমেট খুলে মিরশাদ হুঙ্কার দেয়, ‘‘এই দেখে রাখ! আমি মিরশাদ। ভাইয়ের খুনের বদলা নিলাম।’’
তার পরেই হাওয়ার বেগে মিলিয়ে যায় বাইক। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ইয়ার ও আবেদুল দু’জনকেই মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এ দিনের অপারেশনের ‘ব্লু-প্রিন্ট’ তৈরি হয়েছিল আগেই। মিরশাদ বোরখা পরে ডোমকল ও রমনা শেখপাড়া মোড়ে ঘুরে গিয়েছে আগেই। ছকে নিয়েছিল ইয়ারের রোজনামচা। কোথায় বসে ইয়ার চা খান, কাদের সঙ্গে গল্প করেন, কোন রাস্তা দিয়ে কোন সময় যাতায়াত করেন— সব ছিল তার নখদর্পণে।
স্থানীয় বাসিন্দারাও জানাচ্ছেন, আগে থেকে ছক না করা থাকলে এ ভাবে নিখুঁত কাজ করা যায় না। কারণ, রমনা শেখপাড়ার মোড়ে সকালে ভিড় ভালই থাকে। এ দিনও ছিল। তার মধ্যে বাইকে উড়িয়ে এসে ঠিক ইয়ারকে খুঁজে নিয়েছিল মিরশাদ। শুধু খুঁজে নেওয়াই নয়, নিশানাও ছিল অব্যর্থ। মুম্বই ঘরানা ছাড়া এ কাজ অসম্ভব।
পুলিশের দাবি, বৃহস্পতিবার সকালে মিরশাদ ইয়ারকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল ডোমকল এসডিও মোড়েই। সেখানেই ইয়ার একটি দোকানে চা খাচ্ছিল। কিন্তু আচমকাই ইয়ার সেখান থেকে উঠে বাইকে সোজা চলে যান রমনা শেখপাড়ার মোড়ে। এসডিও অফিসের মোড় থেকে বাইকে পিছু নেয় মিরশাদও।
তারপর রমনায় ‘অপারেশন’ সেরে সে বাজিতপুর হয়ে চলে আসে জলঙ্গি-বহরমপুর রাজ্য সড়কে। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে হিতানপুর মোড় থেকে সে ঢুকে পড়ে টিকটিকিপাড়ার দিকে। কিন্তু সেখানে পুলিশ দেখে সে আবার হিতানপুরে ফেরে। সেখান থেকে কিছুটা পশ্চিমে এগিয়ে নলবাটরা হয়ে ইসলামপুরে ঢুকে পড়ে।
মিরশাদ কি এখনও ইসলামপুরেই আছে? নাকি আশপাশের কোনও গোপন ডেরায় গা ঢাকা দিয়েছে? নাকি সটান ফিরে গিয়েছে মুম্বইয়ে? ঘটনার পরেই মিরশদাকে আটকাতে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মোড়কে নাকাবন্দি করে। কিন্তু তার আগেই পাখি এলাকা থেকে উড়ে যায়— কবুল করছে পুলিশেরই একাংশ।
জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, এলাকায় এই ধরনের ঘটনার পরে মিরশাদ সাধারণত মুম্বইয়ে চলে যায়। এর আগেও সে তা-ই করেছিল। তবে সে ক্ষেত্রে প্লেন বা ট্রেনের চেয়েও সে বেশি ভরসা করে পণ্যবাহী ট্রাককে। মুম্বইগামী ট্রাক চালকদের সঙ্গে তার ভাল খাতির আছে। এই ঘটনার পরে সে তেমন কিছু করেছে কি না তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গ্রাফিক্স: প্রবাল ধর
ইয়ারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, মিরশাদ ও ইয়ার দু’জনেই দু’জনের ‘টার্গেট’ ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুম্বইয়ের কৌশলের কাছে হার মানতে হয়েছে ডোমকলের ইয়ারকে। ইয়ার নিজেও আঁচ করেছিলেন যে, তাঁর উপরে যে কোনও সময় হামলা হতে পারে। সেই কারণে তিনি সাবধানে থাকতেন। চা খাওয়া বা গল্প করার জায়গা হিসেবে তিনি বেছে নিতেন জনবহুল এলাকাকে। কিন্তু নিজের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, জমজমাট এলাকায় সাতসকালে যে এমন কাণ্ড যে ঘটতে পারে তা তিনি আঁচ করতে পারেননি। যেমন তিনি বুঝতে পারেননি বোরখা পরে মিরশাদ তাকে ‘ফলো’ করেছে।
মিরশাদ যে এলাকায় ফিরেছে সে কথা ইয়ার জানতেও পেরেছিলেন। তাঁর ছায়াসঙ্গী হায়দার আলি সরকার বলছেন, ‘‘মামাকে বারবার সাবধান করেছিলাম। কিন্তু মামা বলত ‘মিরশাদ কি উড়ে এসে আমাকে মারবে নাকি?’ অথচ দেখুন, সেই তো উড়ে এসেই মেরে গেল।’’
পুলিশ সূত্রে খবর, মিরশাদ ও ইয়ারের ‘শত্রুতা’ বেশ পুরনো। তেরো বছর আগে খুন হন মিরশাদের বাবা। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন ইয়ার ও তাঁর এক আত্মীয়। সেই আত্মীয়ও পরে খুন হন। সেই খুনে নাম জড়ায় মিরশাদের। দু’বছর আগে মিরশাদের ভাই আরশাদও খুন হন। এ দিনের ঘটনা তারই বদলা বলে মনে করছে পুলিশ। মিরশাদও সে কথা হুঙ্কার দিয়ে জানিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আবেদুল খুন হলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশও।
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘এটা নিছক দুর্ঘটনা নাকি আবেদুল খুনের পিছনেও কোনও রহস্য আছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy