Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
tapas paul

বিদ্রোহ, কেলেঙ্কারি সব ছাপিয়ে তাপসের জন্য রয়ে গেল চোখের জল

জীবন জুড়ে পেয়ে গিয়েছেন ভালবাসা। বিতর্কে জড়িয়ে গেলেন শেষ কয়েকটা বছরে।

‘দাদার কীর্তি’-তে তাপস পাল। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

‘দাদার কীর্তি’-তে তাপস পাল। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৩:০৪
Share: Save:

সাল ২০১৩, সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলার রাজনৈতিক শিবিরের অনেক পোড় খাওয়া মুখ ওই তারিখটায় ফিরছেন আজ। ওই রকম একটা কাণ্ড তাপস পাল ঘটাতে পারেন, সে দিন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না অনেকেই। ২০০১ সালে আলিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী বাছাইয়ের সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হয়তো জানতেন না যে, সাড়ে ১২ বছর পরে তাপস পালের ওই রকম বিদ্রোহ দেখবেন তিনি। ঠিক যে ভাবে ১৯৮০ সালে ‘দাদার কীর্তি’তে মুগ্ধ হওয়া বাংলা জানত না যে, ৩৬ বছর পরে এই ‘দাদা’কেই রোজভ্যালি-কীর্তির অভিযোগে জেলে ঢুকতে দেখা যাবে।

বরাবর তাঁর পরিচিতি এক ‘ভাল মনের মানুষ’ হিসেবে। চেনা পরিসরে বরাবর প্রশংসিত ছিল তাঁর ‘প্রাণখোলা’ মেলামেশা। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অত্যন্ত পরিচিত তারকা তিনি। বাংলার রাজনীতিতে দু’বারের বিধায়ক, দু’বারের সাংসদ তিনি। আর কোনও বাঙালি অভিনেতা এতটা সাফল্য এখনও দেখাতে পারেননি নির্বাচনী রাজনীতিতে। তা সত্ত্বেও জীবনে কখনও ‘ধুরন্ধর’ ভাবমূর্তি তৈরি হয়নি তাঁর। বরং ‘আবেগপ্রবণ’ হিসেবেই ধরা দিয়ে গিয়েছেন চিরকাল।

এত কিছুর পরেও কিন্তু শেষ বছরগুলো একেবারেই ভাল কাটল না তাপস পালের। একের পর এক বিতর্কে ক্রমশ ‘খলনায়ক’ হয়ে উঠছিলেন। প্রচণ্ড মানসিক পীড়াতেই হোক বা শারীরিক কারণে, শেষ দিকটায় অসুস্থও ছিলেন খুবই। তবু তিনি তাপস পাল। মঙ্গলবার সকালে তাঁর মৃত্যুসংবাদ কলকাতার ঘুম ভাঙাতেই শোকের ছায়া নামল প্রায় সব মহলে। বিতর্কগুলো আবার কাঁটার মতো মাথা তুলল ঠিকই, তাঁর নানা ঠিক-ভুলের মূল্যায়ন শুরু হল। কিন্তু সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে জেগে রইল শুধু চোখের জল।

আরও পড়ুন: রাজনীতির ইনিংসে বিতর্কই সঙ্গী থাকল ‘দাদার কীর্তি’র কেদারের

তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাপস পাল।

২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকার আসন আলিপুরে টলিউড স্টারকে প্রার্থী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের রেলমন্ত্রিত্ব ছেড়ে, বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তখন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়েছেন মমতা। বামফ্রন্টকে গোটা বাংলায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে সেই ‘মহাজোট’। তাপস পালের ‘নায়ক’-জীবন তখন নিভে আসার পথে। কিন্তু জনপ্রিয়তা যে নেভেনি, ২০০১-এর সেই ধুন্ধুমার ভোটেই তাপস পাল তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ভোটের হাওয়া যত গরমই থাক, ফলাফলে গোটা বাংলাতেই প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল মহাজোট। কিন্তু তৃণমূলের টিকিটে যাঁরা জিততে পেরেছিলেন সে বার, তাপস পাল তাঁদের অন্যতম ছিলেন।

২০০৬ সালে ফের জেতেন আলিপুর থেকে। সে বার তৃণমূলের আসন আরও কম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ দুর্বল যেন। বাংলা ছবির ‘দাদা’ কিন্তু বাংলার রাজনীতির ‘দিদি’কে ছেড়ে যাননি। ২৩৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য। কিন্তু তাপসের বিরুদ্ধে অভিনেতা তথা বাম প্রার্থী বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় জিততে পারেননি।

এ সবের এক দেড় বছর পর থেকেই তৃণমূলের উত্থান শুরু বাংলায়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে। তাপস পালেরও ভূমিকা বেড়েছিল। আলিপুরের বিধায়ককে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৯ সালের সেই লোকসভা নির্বাচনে বাম সাংসদ জ্যোতির্ময়ী শিকদার এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা কৃষ্ণনগরের প্রবাদপ্রতিম বিজেপি নেতা সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়কে হারিয়ে জিতে যান তাপস। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় বার জেতেন ওই কেন্দ্র থেকেই।

আরও পড়ুন: ‘ভেনিসের রাস্তায় নাচতে শুরু করল তাপস’, মনে পড়ছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের

২০১৪ সালে তাপস পাল আর টিকিট পাবেন কি না, তা নিয়ে কিন্তু সন্দেহ ছিল অনেকেরই। কারণ তার আগের বছরই আচমকা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন তাপস পাল। কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে এক রক্তদান শিবিরের মঞ্চ থেকে ২০১৩-র ২০ সেপ্টেম্বর তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ সোমেন মিত্র, রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ, বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়, কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল। দল যে ভাবে চালানো হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল মূলত। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, এই সাংসদদের আসল নিশানা সে দিন ছিলেন তৃণমূলের তৎকালীন সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড মুকুল রায়। সে দিন আরও অনেক মহারথীর সে মঞ্চে হাজির হওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যান তাঁরা। আবেগপ্রবণ তাপস কিন্তু সে পথে হাঁটেননি।

তৃণমূলের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছিল সেই ‘বিদ্রোহ’ ঘিরে। পরের দিনই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন তাপস-শতাব্দী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে বিতর্ক আর পিছু ছাড়েনি তাপসের।

‘বিদ্রোহ’ দেখে প্রবল রুষ্ট হন নেত্রী। তাপসের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও নেত্রী সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে জানা যাচ্ছিল। তার পরেও ২০১৪ সালে কৃষ্ণনগরে তাপসই টিকিট পান। জিতেও ফেরেন। কিন্তু কিছু দিন পরেই সামনে আসে এক ভিডিয়ো। তাতে দেখা যায় অভিনেতা-সাংসদ নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বিরোধীদের ঘরে ‘ছেলে ঢুকিয়ে’ দেওয়ার হুমকি দিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করছেন।

এক সময় তাপস পালের কুশপুতুলও দাহ হয়েছে।

তাপস পালের ভাষণের ওই ভিডিয়ো তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে গোটা বাংলায়। সাংসদের প্রবল নিন্দা শুরু হয় নানা মহলে। সে সবের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম জড়ায়। ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সেই অভিযোগে সিবিআই গ্রেফতার করে নেয় তাপস পালকে।

ভাবমূর্তির আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ভুবনেশ্বরে দীর্ঘ বন্দিদশায় ছটফট করছিলেন সম্ভবত। স্নায়ুর সমস্যা ছিল। সে সমস্যা আরও বেড়েছিল বন্দি থাকাকালীন। জামিন পাওয়ার পরে ঈশ্বরের নাম নিয়ে তাপস পালের আকুল কান্নার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলায়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে আর টিকিট পাননি। জনপরিসর থেকে ক্রমশ অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। শরীর ভাঙছিল বলে খবর মিলছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিসর থেকে। শেষ ক’টা দিন কাটল ভেন্টিলেশনে। শেষ হয়ে গেলেন তাপস পাল।

আরও পড়ুন: ‘অভিনয় ও রাজনৈতিক জগতে অপূরণীয় ক্ষতি’, তাপস পালের প্রয়াণে শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

অর্থলগ্নি কেলেঙ্কারি বা অশ্লীল ভাষণ বিতর্কে তাপস পালকে যাঁরা তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, মঙ্গলবার তাঁর মৃত্যুসংবাদে তাঁরাও কিন্তু বিহ্বল। ক্রমশ যে ভাবে ফুরিয়ে গেলেন তাপস, অভিনয়-রাজনীতি-ভাবমূর্তি যে ভাবে মুছে গেল শেষ ৭-৮ বছরে, তা মর্মাহত করেছে তাঁর বিরোধীদেরও। কারণ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে হোক বা রাজনীতিতে, বিরোধী যাঁরা ছিলেন, আলাপ থাকলে তাঁদের সঙ্গেও খোলামেলাই মিশতেন তাপস পাল। টলিউডের স্টার বা বার বার ভোটে জিতে আসা নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাপস পালের ওই ‘সহজ-সরল’ মেলামেশা অনেককেই অবাক করত। মত ঘনিষ্ঠদের। এ দিন অনেকের স্মৃতিচারণেই বার বার উঠে এসেছে সে কথা। ভারাক্রান্ত মন ছাপিয়ে গিয়েছে বিতর্কগুলোকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE