আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের যে ঘরটিতে সিপিএমের সাংবাদিক বৈঠক হয়, সেই ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে একটা বিশাল বিশ্ব-মানচিত্র। সত্তরের দশকে লাগানো সেই মানচিত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন আজও অবিভক্ত! ধূলি-ধুসরিত মানচিত্রটিতে সোভিয়েতের ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার কোনও প্রতিফলনই নেই। ঘরটিতে রয়েছে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া পুরনো কিছু ছবিও। রয়েছেন স্তালিন। আর ঘরের দেওয়ালে সেলোটেপে আটকানো ছেঁড়া ক্যালেন্ডার।
দলের আর একটি প্লেনাম যখন আসন্ন, সেই সময়ে দাবি উঠেছে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার মানচিত্রটা বদলে ফেলা হোক। দলকে চাঙ্গা করতে মান্ধাতা আমল থেকে তো বেরোতে হবে! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। ঘরটি নতুন করে সাজাতে বুদ্ধবাবু নির্দেশও দিয়েছেন। সূর্যকান্ত মিশ্র নিজে এই ঘরে আজকাল সাংবাদিক বৈঠক করেন। টেলিভিশনের যুগে সব রাজনৈতিক দলই তাদের অফিসের চেহারাটা বদলে দিয়েছে। সবাই চাইছে একটা ঝাঁ চকচকে ছবি ক্যামেরার সামনে ফুটিয়ে তুলতে। বিমান বসু সহকর্মীদের নতুন মানচিত্র নিয়ে আসতে বলেছেন। কিন্তু এত ভাল বিশ্ব মানচিত্র পাওয়াও যাচ্ছে না।
আলিমুদ্দিনে রাখার জন্য সেই মানচিত্রের খোঁজ কবে মিলবে, তা পরে বোঝা যাবে। তবে প্লেনাম উপলক্ষে পরিবর্তনের খসড়া নিয়ে দলে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। ডিসেম্বরে কলকাতায় বসতে চলেছে সিপিএমের প্লেনাম। ৩৭ বছর আগে ১৯৭৮ সালে সালকিয়া প্লেনামে জনতা পার্টি সরকারের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে এ বার কলকাতা প্লেনামের আলোচ্য বিষয় সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে পরের বছর ভোট। তার আগে সংগঠনকে সাজানোর চেষ্টা। থাকবে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর কিছু দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা। সংগঠনের নির্দিষ্ট সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তার সমাধান খোঁজাই সিপিএমের উদ্দেশ্য। দিল্লিতে এ বারের পলিটব্যুরোর বৈঠকে প্রকাশ কারাটকে বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রশ্নাবলি গ্রহণ ও তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতে প্লেনামের একটি রিপোর্ট তৈরি হবে। দল সীতারাম ইয়েচুরিকে দায়িত্ব দিয়েছে, সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে দলীয় সিদ্ধান্ত কী হবে, তার খসড়া তৈরি করতে। সেই প্রস্তাবেই থাকবে দলের ভবিষ্যৎ।
কিন্তু কোন ধরনের পরিবর্তনের কথা ভাবছে দল?
সিপিএমের সূত্র বলছে, বার বার বিপর্যয়ের পরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় কিছু জিনিস বর্জন করার ভাবনা দলের সামনে আসছে। কয়েকটি বিষয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করার কথাও রয়েছে। যেমন,
• ক্লিশে হয়ে যাওয়া স্লোগানের বদল। দল এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত ভেঙে দেওয়ার স্লোগান আর কর্মী সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায় না। দক্ষিণ চিন সাগরে পৌঁছে যাওয়া মার্কিন রণতরী ডুবিয়ে দিতে কলকাতায় মিছিলে হেঁটে গলা ফাটানোর অর্থ হয় না। কেননা, এ সবে আর সাড়া দেয় না দেশের সাধারণ মানুষ। বরং স্থানীয় বিষয়গুলি নিয়ে তারা আগ্রহী। তাই বিজলি-পানির আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে আম আদমি পার্টি। অথচ বামপন্থী দল হয়েও সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারছে না সিপিএম। তাই পুরনো স্লোগান পাল্টে বাস্তবে মানুষের সমস্যাকেন্দ্রিক ভাবনা
ভাবতে হচ্ছে ইয়েচুরিদের।
• মানসিকতার বদল। উদাহরণ, অতীতে কম্পিউটার থেকে শুরু করে আজ শপিং মলের বিরোধিতা। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একটা অংশ বুঝছেন, নতুন প্রজন্মকে টানতে কিংবা তাদের ধরে রাখতে হলে পুরনো ঝোঁক বদল করতে হবে—গ্রহণ করতে হবে সময়ের নতুন সুবিধা। যেমন প্রচারের সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার। নরেন্দ্র মোদী কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেদের প্রচারে টুইটারে এসেছেন। কিন্তু সেই জগৎ থেকে শত যোজন দূরে প্রকাশ কারাট। সীতারাম যদিও দিন কয়েক আগেই নাম লিখিয়েছেন টুইটারে।
• সিপিএমকে সব থেকে বেশি চাপে ফেলেছে নতুন প্রজন্মের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। সংগঠনকে চাঙ্গা করার জন্য চাই নতুনদের আরও অগ্রাধিকার। চাই এ নিয়ে পুরনো জড়তার বর্জন। সিপিএম নেতারা বুঝতে পারছেন, এ ব্যাপারে তাদের গতি খুবই শ্লথ। গণ সংগঠনেও পড়ছে এর ছায়া।
তবে এই নতুন ভাবনার মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে, এতটা চ্যালেঞ্জ কি আদৌ নিতে পারবে সিপিএম? দিল্লির গোপালন ভবন থেকে কলকাতার আলিমুদ্দিন— দলকে বদলে দেওয়ার কাজটা বাস্তবে কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে নেতাদের মনেও রয়ে গিয়েছে সংশয়। বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র দলীয় বৈঠকে কমরেডদের বলছেন, ভাবার কোনও কারণ নেই যে বিধানসভা ভোটে তৃণমূল হেরে যাবে আর সিপিএম ক্ষমতায় আসবে। তবে সংগঠনকে মজবুত করতে হবে। মানুষ যেন ভাবতে শুরু করে, পুরনো দল নয়, এ বার আসবে নতুন সিপিএম।তবে এ সব কথা দলের কর্মীদের মনে কতটা দাগ কাটছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের ভাষায়, ‘‘ফজলি থেকে ফজলিতর আম হয় না।’’ তাই আম নয়, নিয়ে আসতে হবে নতুন কিছু।
আপাতত সব চিন্তা এই নতুনের খোঁজেই। থাকছে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশল। সে কারণেই বিহার ভোটের ফলাফল নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাচ্ছে না সিপিএম পলিটব্যুরো। বরং সাংগঠনিক বিচ্যুতি দূর করতে তারা অনেক বেশি মরিয়া। এ বারের পলিটব্যুরো এবং আসন্ন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস, এমনকী মুকুল রায়ের সম্ভাব্য দলের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেও রাজি নয়।
সিপিএম সূত্র বলছে, সীতারাম ইয়েচুরি সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা আছে, তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা চান। অর্থাৎ, নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির বদলে অন্যের সাহায্যে লড়াইয়ে টিঁকে থাকতে বেশি আগ্রহী। সম্ভবত এই কারণেই সীতারাম এখন আরও বেশি সচেতন। তিনিও সংগঠনের কাজের জন্য অনেক বেশি জোর দিতে চাইছেন। আর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের কী রণকৌশল হবে, সে ব্যাপারেও তড়িঘড়ি করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দেখতে চাইছেন, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।
৩৭ বছর পরের এই প্লেনাম সিপিএমের বদলে যাওয়ার ভাবনাকে আদৌ বাস্তবের মাটিতে টেনে আনতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে সিপিএমের অনেকেই লঘু সুরে বলছেন, আগে তো আলিমুদ্দিনের মানচিত্রটা বদলে ফেলুন বিমানবাবুরা! যদিও এর মধ্যেই দিল্লিতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এ কে জি ভবনে একটি বিষয়ে বদল এনেছেন ইয়েচুরি। সাংবাদিক বৈঠকে যা কখনও হয়নি, সেটাই হয়েছে এ বার। কী সেই পরিবর্তন? হাসতে হাসতে কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের মন্তব্য, দেখছেন না, বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমকে এখন চায়ের সঙ্গে বিস্কুটও দেওয়া হচ্ছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy