Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্রাথমিক স্কুলে আজব নিয়োগ, মহা কেলেঙ্কারির আঁচ হাওড়ায়

‘ব্যপম’ কেলেঙ্কারির জেরে ঝড় উঠেছে মধ্যপ্রদেশে। প্রায় তেমনই এক দুর্নীতির ছায়া এ বার হাওড়ার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগেও! অন্তত আনন্দবাজারের অনুসন্ধানে উঠে আসা তথ্য তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যা শুনে যুক্তিগ্রাহ্য কোনও ব্যাখ্যাও নিয়োগকারীরা দিতে পারছেন না। ফলে গোটা প্রক্রিয়া ঘিরে দুরন্ত দুর্নীতির সন্দেহ ক্রমশ জোরদার।

পুলককান্তি দেব

পুলককান্তি দেব

দেবাশিস দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০২
Share: Save:

‘ব্যপম’ কেলেঙ্কারির জেরে ঝড় উঠেছে মধ্যপ্রদেশে। প্রায় তেমনই এক দুর্নীতির ছায়া এ বার হাওড়ার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগেও! অন্তত আনন্দবাজারের অনুসন্ধানে উঠে আসা তথ্য তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যা শুনে যুক্তিগ্রাহ্য কোনও ব্যাখ্যাও নিয়োগকারীরা দিতে পারছেন না। ফলে গোটা প্রক্রিয়া ঘিরে দুরন্ত দুর্নীতির সন্দেহ ক্রমশ জোরদার।

কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীকে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ঘিরে সিবিআই-তদন্ত চলছে মধ্যপ্রদেশের নিয়োগকারী সংস্থা ‘ব্যপম’-এর বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ওই কেলেঙ্কারিতে বহু রাঘববোয়াল জড়িত। একই ভাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-য় হাওড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ যে ১ হাজার ৮২৬ জনকে শিক্ষক পদে চাকরির নিয়োগপত্র দিয়েছে, তাঁদের অনেকেও যোগ্যতামানের ধারে-কাছে নেই! তা সত্ত্বেও ওঁরা হাওড়ার বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে দিব্যি চাকরি করছেন বলে আনন্দবাজারের অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে।

প্রাথমিকে শিক্ষকপদের পরীক্ষায় বসার জন্য কী যোগ্যতা চেয়েছিল হাওড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ?

এ ব্যাপারে ২০১০-এর ২২ এপ্রিল কলকাতার বিভিন্ন দৈনিকে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল সংসদ। তাতে বলা ছিল, সাধারণ বিভাগের (জেনারেল ক্যাটিগরি) প্রার্থীদের মাধ্যমিকে অন্তত ৬৮% নম্বর পেতে হবে। তফসিলি জাতি-উপজাতির (এসসি, এসটি) ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৫৫% ও ৩৪%, ওবিসি’র ক্ষেত্রে ৬৩%।

অর্থাৎ নিয়ম অনুযায়ী, মাধ্যমিকে ওই ন্যূনতম নম্বর না-পেলে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষাতেই বসা যায় না। অথচ খোঁজ-খবর করে জানা যাচ্ছে, যোগ্যতামান না-পেরিয়েও অনেকে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন! যেমন?

উদাহরণ ১: অরিন্দম গোস্বামী। শিবপুরের শিশুতীর্থ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক।

জোকার বাসিন্দা অরিন্দমের জমা দেওয়া মাধ্যমিকের মার্কশিট বলছে, তৃতীয় ডিভিশনে পাশ করা ওই যুবক মাধ্যমিকে মোট ৩৯.৩৭% নম্বর পেয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষকের পরীক্ষায় বসার জন্য ন্যূনতম যা দরকার, তার চেয়ে ২৮% কম। অঙ্কে ২১, ইতিহাসে ৩৩, ভূগোলে ৩৫। এই নম্বর নিয়ে তিনি কী করে শিক্ষকের চাকরির পরীক্ষায় বসলেন?

অরিন্দম বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমি তো লিখিত পরীক্ষায় বসিনি! সংসদ আমার ভাইভা (মৌখিক পরীক্ষা) নিয়েছিল। তার পরেই নিয়োগপত্র পাই।’’

উদাহরণ ২: মোল্লা ইনতাজুল হক। শিবপুরের শিশুতীর্থ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক।

বর্ধমানের বাসিন্দা ইনতাজুল মাধ্যমিকে পেয়েছেন ৫৫.৬২%। যোগ্যতামানের ১৩% কম। ইনতাজুলেরও দাবি, তিনি লিখিত পরীক্ষায় বসেননি। ‘‘ভাইভা দিয়েই চাকরি হয়েছে।’’— বলছেন তিনি।

উদাহরণ ৩: রশিদা খাতুন। হাওড়া ময়দানের বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।

উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদের মেয়ে রশিদার মাধ্যমিকের নম্বর ৫৩.৬৩%। আবেদনপত্রের সঙ্গে তিনি ওবিসি সার্টিফিকেট পেশ করেছেন, সেই সুবাদে ন্যূনতম যোগ্যতামানের (৬৩%) চেয়ে তাঁর নম্বর প্রায় ১০% কম। কী ভাবে চাকরি পেলেন?

রশিদার জবাব, ‘‘আমি কিছু বলব না। সংসদকে জিজ্ঞাসা করুন।’’

শুধু এই তিন জন নয়। অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরিলাভের এমন অজস্র উদাহরণ আনন্দবাজারের হাতে মজুত। এমতাবস্থায় সর্বাগ্রে প্রশ্ন উঠছে, ২০১২ সালেই পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের জন্য ‘টেট’ চালু হয়ে গিয়েছে। তা হলে ২০১৪-য় হাওড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ কী ভাবে নিজেরা শিক্ষক নিয়োগ করল?

জবাব দিতে গিয়ে সংসদের কর্তারা চলে যাচ্ছেন ছ’বছর আগে। কী রকম?

ওঁরা জানাচ্ছেন, ২০০৯-এর ৩০ অগস্ট রাজ্যের সমস্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল। পরের বছর ২১ এপ্রিল আর একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে লিখিত পরীক্ষায় বসার মেধা তালিকা তৈরি করতে। তালিকা বানিয়ে পরীক্ষাও নেওয়া হয়। উত্তীর্ণদের ভাইভা-ও হয়ে যায় ২০১০-এ।

কিন্তু প্যানেল মোতাবেক নিয়োগ শুরুর আগেই রাজ্যে সরকার বদলে যায়।

সংসদ-কর্তাদের বক্তব্য: নতুন সরকার ২০১২-য় প্যানেলটি বাতিল করে পুরো প্রক্রিয়া নতুন ভাবে শুরু করার নির্দেশ দেয়, যার বিরুদ্ধে মামলা হয় হাইকোর্টে। ২০১৪-য় হাইকোর্টের বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য ও বিচারপতি ঈশানচন্দ্র দাসের ডিভিশন বেঞ্চ সরকারি নির্দেশই বহাল রাখে। সেই মতো ২০১৪-র ১০ অগস্ট আগের প্রার্থীদের নতুন পরীক্ষা নেয় হাওড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। আর ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে ১৮২৬টি পদে নিয়োগ শুরু হয়ে যায়।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

ন্যূনতম যোগ্যতামান না-উতরেও কারও কারও চাকরি হয়ে গেল কোন যুক্তিতে? জানতে চাওয়া হলে হাওড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান পুলককান্তি দেব স্পষ্ট যুক্তি দিতে পারেননি। প্রথমে বলেন, ‘‘যাঁদের চাকরি হয়েছে, তাঁরা পুরনো প্যানেলের।’’ পরে বলেন, ‘‘সল্টলেকের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সদর অফিসের পাঠানো প্যানেল থেকে চাকরি হয়েছে। এতে আমাদের কিছু করার নেই।’’ কিন্তু নাম যে প্যানেলেরই হোক, যোগ্যতামান না-ছুঁয়ে, লিখিত পরীক্ষায় না-বসে, স্রেফ মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে কি চাকরি হতে পারে?

এরও পরিষ্কার জবাব চেয়ারম্যান দিতে পারেননি। বরং যা বলেছেন, তার মাধ্যমে প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন যে, উল্লিখিত প্রার্থীরা যোগ্যতামান পেরোতে পারেননি। ‘‘মাধ্যমিকে ওঁরা কম নম্বর পেলেও আমাদের নেওয়া পরীক্ষায় পাশ করেছেন। তাই চাকরি হয়েছে। যোগ্যতা দেখার প্রশ্ন ওঠেনি।’’— মন্তব্য তাঁর। এটা কি সরকার ও আদালতকে সরাসরি উপেক্ষা নয়?

পুলকবাবুর কাছে উত্তর মেলেনি। অন্য দিকে বিরোধীদের অভিযোগ, হাওড়ায় প্রাথমিকে নিয়োগের নেপথ্যে বিশাল মাপের কেলেঙ্কারি হয়েছে। হাওড়া পুরসভার প্রাক্তন সিপিএম কাউন্সিলর তথা হাইকোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদের কথায়, ‘‘মাথাপিছু ৮-১০ লাখ টাকা নিয়ে অযোগ্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। আমরা তদন্ত চাইছি।’’ কংগ্রেসের জেলা সভাপতি কাজী আব্দুল রেজ্জাকও সিবিআই-তদন্ত দাবি করেছেন। ওঁদের আঙুল মূলত শাসকদলের দিকেই। ‘‘সিবিআই-তদন্ত হলে তৃণমূলের বহু নেতা জেলে ঢুকবেন।’’— পর্যবেক্ষণ বিজেপি জেলা সভাপতি তুষারকান্তি দাসের।

শাসকদলের কী বক্তব্য?

দলের মন্ত্রী-নেতারা নিজেদের উপর থেকে দায় ঝাড়ছেন। প্রতিবিধানের আশ্বাসও দিচ্ছেন। তৃণমূলের হাওড়া জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘এমনটা ঘটে থাকলে রাজ্য সরকার নিশ্চয়ই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। মা-মাটি-মানুষের সরকার কোনও দুর্নীতি বরদাস্ত করে না।’’

মন্ত্রীর আশ্বাস প্রশাসন কতটা কার্যকর করে, সেটাই এখন দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE