Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষার ভরসাতেই এগোচ্ছেন মেয়েরা

সাত বছর আগে নিজের বিয়ে রুখে খবরের শিরোনামে এসেছিল পুরুলিয়ার নাবালিকা স্কুল পড়ুয়া রেখা কালিন্দী। পাঁচ বছর আগে বর্ধমানের তহমিনা বেগম তাঁর স্বামীকে জানিয়েছিলেন, তাঁদের দুটি সন্তান আছে। আর সন্তান চান না তিনি, তাই গর্ভনিরোধক ব্যবহার করা জরুরি।

মধুরিমা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

সাত বছর আগে নিজের বিয়ে রুখে খবরের শিরোনামে এসেছিল পুরুলিয়ার নাবালিকা স্কুল পড়ুয়া রেখা কালিন্দী। পাঁচ বছর আগে বর্ধমানের তহমিনা বেগম তাঁর স্বামীকে জানিয়েছিলেন, তাঁদের দুটি সন্তান আছে। আর সন্তান চান না তিনি, তাই গর্ভনিরোধক ব্যবহার করা জরুরি। তিন বছর আগে বাড়ির লোক তাঁর পাঁচ মাসের শিশু সন্তানকে পোলিও প্রতিষেধক খাওয়াতে বাধা দেওয়ায় রুখে দাঁড়ান মেটিয়াবুরুজের আমিনা বেগম। জানিয়ে দেন, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এমন সর্বনাশা সিদ্ধান্ত মানতে পারবেন না তিনি।

এগুলি কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না কি ক্রমশ এ ভাবেই নিজেদের মতামতকে পরিবারে প্রতিষ্ঠা করছেন এই রাজ্যের মেয়েরা? চতুর্থ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস) থেকে ফের ইঙ্গিত মিলল, শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতারও। রাজ্যে মেয়েদের শিক্ষার হার যত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে উন্নতি হচ্ছে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের নানা সূচকের। সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫-১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। যা ২০০৫-০৬ সালে ছিল ৫৮.৮ শতাংশ। একই সঙ্গে, প্রতি হাজারে আগে ৪৮ জন শিশু মারা যেত। দশ বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৭। জন্মের নথিভুক্তিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৭ শতাংশ।

এ ছবি শুধু এ রাজ্যে নয়, গোটা দেশেই। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি রিপোর্ট জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, পুরুষদের রোজগার বাড়লে, পরিবারের দারিদ্র কমলে শিশু মৃত্যুহার (এক বছরের নীচে হাজার শিশুতে যতগুলি মৃত্যু) সামান্যই কমছে। তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে দু’টি বিষয়: মেয়েদের শিক্ষা আর স্বাস্থ্য পরিষেবার সুলভতা। গোয়া, মণিপুর, কেরলের মতো রাজ্যে মেয়েদের সাক্ষরতার হার বেশি, শিশুদের মৃত্যুহার খুব কম। আবার বিহারে মেয়েদের সাক্ষরতার হার সব চেয়ে কম, সেখানে শিশুর মৃত্যুহারও দেশের মধ্যে সর্বাধিক।

কী করে স্কুলের লেখাপড়া বদলে দেয় শিশুমৃত্যুর ছবি? তার কিছু উত্তর মিলছে। এক, কিশোর বয়সে অপরিণত দেহে প্রসব সন্তান ও মা, দু’জনের জন্যই মস্ত ঝুঁকি। স্কুলের শেষ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনার প্রচলন বাড়ার ফলে বিয়ে ও মাতৃত্বের বয়স পিছিয়েছে। বছর দশেক আগেও এ রাজ্যে ১৮ বছরের নীচে বিয়ে করা মেয়েদের সংখ্যাটা ছিল ৫৩ শতাংশেরও বেশি। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।

রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতরের সচিব রোশনি সেনের দাবি, অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এ রাজ্যে গত কয়েক বছরে অনেক বেশি স্কুল তৈরি হয়েছে। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাঘাটও বেড়েছে অনেক। ফলে স্কুলে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যাও বেড়েছে আগের তুলনায়। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলগুলিতে মেয়েদের শৌচালয় না থাকায় অনেকেই স্কুলমুখো হতো না। বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক স্কুলে মেয়েদের জন্য শৌচালয় তৈরি হচ্ছে। এর ফলে শুধু যে স্কুলে যাওয়া নিয়মিত হয়েছে তাই নয়, স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতনতাও বেড়েছে মেয়েদের।’’

সেই সঙ্গে সমাজতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার ফলে একটা সমাজবোধ তৈরি হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাইরে মেলামেশার ফলে আলোচনা এবং মত প্রকাশের একটা জায়গাও ক্রমশ তৈরি হচ্ছে। তার ফলে প্রয়োজনে পরিবারের মতের বিরুদ্ধে গিয়েও মেয়েরা নিজের ও শিশুর স্বার্থে নানা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। সমীক্ষা বলছে, পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিরোধক ব্যবহারেও মেয়েদের অংশগ্রহণ আগের থেকে বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র বলেন, ‘‘শিক্ষা মানে কেবল বইপত্র পড়া নয়। অন্য মানুষও আমাদের শেখার উত্স। পাঁচ জনের সঙ্গে আলাপ হয়, সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তা থেকে একটা বোধ জন্মায়। মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ছে মানে তাঁদের জানার পরিধি বাড়ছে।’’

সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তাদের দাবি, তেমন কোনও শর্ত না চাপিয়েও এ রাজ্যে পরিবারপিছু সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা গিয়েছে। এমনকী দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্থান উপরের দিকে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ নেওয়ার ঝোঁকও বেড়েছে। প্রায় ৭৫ শতাংশ মহিলাই হাসপাতালে গিয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এমনকী গর্ভাবস্থায় আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট নিয়মিত খাচ্ছেন অনেকে। শিশুর স্বাস্থ্যেও তার সুপ্রভাব পড়ছে।

জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য অধিকর্তা সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ বলেন, ‘‘মেয়েরা নিজেরা নিজেদের শরীর এবং পরিবার সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে বলেই পরিবারপিছু সন্তানের জন্ম কমছে। গর্ভনিরোধকের ব্যবহার বাড়ছে। এটা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যার মধ্যে শিক্ষার বিস্তার এবং সহজেই সেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুবিধা গ্রহণের সুযোগ থাকা হল অন্যতম কারণ।’’

স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শুধু বিভিন্ন ওষুধের ব্যবহার এবং সহজে তা পাওয়ার সুযোগই নয়, কাউন্সেলিংয়ের ক্ষেত্রেও জোর দিয়েছে বর্তমান সরকার। সরকারি হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য ‘অন্বেষা ক্লিনিক’-এ কাউন্সেলিং চালু করার ফলেও সচেতনতা অনেক বেড়েছে।

তবে এই সমীক্ষা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে গ্রাম ও শহরের ব্যবধানে। গ্রামে যেখানে হাজার শিশুর মধ্যে ৩২ জন মারা যাচ্ছে বছর না পেরোতেই, শহরে সেখানে মৃত্যুহার ১৬। এই মস্ত ব্যবধান কি স্বাস্থ্য
পরিষেবায় বৈষম্যকেই ইঙ্গিত করে না? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী দাবি করেন, গ্রামে স্বাস্থ্য পরিষেবার দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। তার ফল আর কিছু দিন পরে স্পষ্ট হবে। তবে তিনি বলেন, ‘‘গ্রামের দিকে মেয়েদের এখনও কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এটাও বেশি শিশুমৃত্যুর একটি কারণ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

girl child education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE