Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
স্বাধিকার উস্কেই নয়া বিতর্কে পার্থ

অধ্যক্ষদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বার্তা

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন দেয় সরকারই। সেই সুবাদেই ওই সব প্রতিষ্ঠানে তাঁরা হস্তক্ষেপ করতে পারেন বলে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:২৫
Share: Save:

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন দেয় সরকারই। সেই সুবাদেই ওই সব প্রতিষ্ঠানে তাঁরা হস্তক্ষেপ করতে পারেন বলে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। রবিবার কলেজের অধ্যক্ষদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে নতুন বিতর্ক এবং কিছু প্রশ্ন উস্কে দিলেন তিনি।

আংশিক সময়ের শিক্ষক সংগঠন ‘কুটাব’-এর মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রী এ দিন সংগঠনের সদস্যদের বলেন, ‘‘কলেজে ফিরে অধ্যক্ষদের বলবেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। আমাদের কেন ফোন করে নির্দেশ দিতে হবে? কেন বলতে হবে, একে অ্যারেস্ট করুন, তাকে অ্যারেস্ট করুন। অধ্যক্ষেরা নিজের পায়ে দাঁড়ালে আমরা খুশি হবো।’’ আংশিক সময়ের শিক্ষকদের নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্থবাবু বলেন, কলেজে যাতে নিয়মিত ক্লাস হয়, সে-দিকে নজর রাখতে হবে তাঁদেরই।

সরকার ইদানীং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে বারবার নাক গলাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সেই হস্তক্ষেপের যুক্তি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী বারংবার বেতন জোগানোর কথা বলে আসছেন। জেলায় জেলায়, এমনকী কলকাতা এবং শহরতলির কলেজেও অধ্যক্ষেরা নিজের প্রতিষ্ঠানে নিগৃহীত হচ্ছেন। সেই সব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আঙুল উঠছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বা টিএমসিপি-র দিকে। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষামন্ত্রীকে কেন অধ্যক্ষদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বার্তা দিতে হচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠছে শিক্ষা শিবিরে।

শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বলছেন, কলেজ প্রশাসন চালাতে অধ্যক্ষেরা যে স্বাবলম্বী নন, এ দিন সেই কথাটাই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন পার্থবাবু। তাঁদের প্রশ্ন: l অধ্যক্ষেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারছেন না, এই বার্তা দিয়ে মন্ত্রী কি সরকারি হস্তক্ষেপেরই যুক্তি সাজাচ্ছেন? l নাকি মন্ত্রী বোঝাতে চাইছেন, স্বাধিকার চাইলে স্বাবলম্বী হওয়া দরকার এবং অধ্যক্ষেরা তা হতে পারছেন না। তাই নতুন বার্তা?

‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি সামলাতে আমি যদি কোনও নির্দেশ দিই, স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে হইচই শুরু হয়ে যায়। আর যদি কিছু না-বলি, তখন অভিযোগ ওঠে, সরকার কিছুই করছে না! আমার হয়েছে মহা মুশকিল!!’’— অধ্যক্ষদের স্বাবলম্বনের নতুন বার্তা দিতে গিয়ে এ ভাবে সংবাদমাধ্যমকেও একহাত নেন শিক্ষামন্ত্রী। আর শিক্ষা শিবিরের একাংশের মতে, স্বাধিকারের প্রসঙ্গ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়াতেই স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ বা নির্দেশও নতুন বিতর্কের উৎস হয়ে উঠছে।

অনেক কলেজ-শিক্ষকের অভিযোগ, নির্দিষ্ট শিক্ষা ও যোগ্যতামান পেরিয়েই অধ্যক্ষেরা কলেজে নিযুক্ত হন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন পরিচালনা ও শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে বারবার সরকারি হস্তক্ষেপের মুখ পড়তে হচ্ছে তাঁদের। নিত্যদিন হেনস্থা হতে হচ্ছে ছাত্র সংগঠনের হাতে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উপরে শাসক দল এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ নতুন কিছু নয়। বাম আমলেও শিক্ষা ক্ষেত্রের রাশ ছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের হাতেই। এই আমলে সেই নিয়ন্ত্রণের চেহারা পুরোপুরি বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগেও সরকারের পছন্দই যে শেষ কথা, তা বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রতনলাল হাংলুকে নিয়ে তাঁর শনিবারের মন্তব্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফি কমানোর দাবিতে বুধবার সারা রাত উপাচার্যকে ঘেরাও করে রাখেন ছাত্রছাত্রীরা। বৃহস্পতিবার সকালে আইন মেনে উপাচার্য তাঁর নিয়োগকর্তা রাজ্যপাল তথা আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আচার্য তা গ্রহণ না-করায় তিনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই অবস্থায় পার্থবাবু শনিবার বলেন, ‘‘ছাত্রদের ফি না-কমালে হাংলু হোক আর যে-ই হোক, তাঁকে রাখব না।’’ যা শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই বলছেন, উপাচার্য ওই পদে থাকবেন কি না, সেটা আচার্য দেখবেন। পার্থবাবু আগ বাড়িয়ে কথা বলার কে? ভর্তির ফি কমানো হবে কি না, সেটাও রাজ্য সরকারের দেখার কথা নয়।

একই ভাবে কলেজ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অধ্যক্ষের এবং তিনি কী ভাবে নিজস্ব কৌশলে প্রতিষ্ঠানের কাজ চালান, সেটা তাঁর ব্যাপার বলে মনে করেন ওই শিক্ষকেরা। তাঁদের প্রশ্ন, শিক্ষামন্ত্রী নিজের দলের ছাত্র সংগঠনকে সংযত না-করে এবং অধ্যক্ষেরা যাতে কারও হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজেদের মতো কাজ চালাতে পারেন, সেই পরিবেশ সৃষ্টি না-করে তাঁদের স্বাবলম্বী হতে বলছেন কী ভাবে? তাঁদের আরও প্রশ্ন, আংশিক সময়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে অধ্যক্ষদের কাছে স্বাবলম্বী হওয়ার বার্তা পাঠানোর মানেটাই বা কী?

অধ্যক্ষ-অধ্যক্ষারা কী বলছেন?

লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষা শিউলি সরকারের বক্তব্য, বর্তমানে হয়তো অনেক অধ্যক্ষই স্বাবলম্বী হয়ে কাজ করতে পারেন না। তাই শিক্ষামন্ত্রী এই মন্তব্য করেছেন। ‘‘নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মানে যদি স্বাধিকার হয়, তা হলে আমাদের কলেজ পুরোপুরি সরকারি। সে-ক্ষেত্রে স্বাধিকারের সিদ্ধান্তটা রাজ্য সরকারের,’’ বললেন শিউলিদেবী।

গোখেল মেমোরিয়াল কলেজের অধ্যক্ষা অতসী কার্ফা মনে করেন, স্বাবলম্বী না-হলে কলেজ চালানো যায় না। সমস্যা হলে আগে কলেজ-কর্তৃপক্ষকে সেটা মেটানোর চেষ্টা করতে হবে। সেই সঙ্গে অতসীদেবী যোগ করলেন, ‘‘তবে এটাও ঠিক যে সরকারি কিছু নিয়ম থাকে। সেগুলো আমাদের মেনে চলতেই হবে।’’

শিক্ষামন্ত্রীর এ দিনের বার্তার ব্যাপারে বক্তব্য জানতে নিখিল বঙ্গ অধ্যক্ষ পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দীপককুমার কর ফোনই ধরেননি। আর সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী সব সময়েই অধ্যক্ষদের স্বাধীন ভাবে কাজ করতে বলেন। তবে কখনও কোনও প্রয়োজন হলে প্রশাসন পাশে থাকবে বলেও আশ্বাস দেন।’’

কিন্তু আংশিক সময়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে অধ্যক্ষদের স্বাবলম্বী হওয়ার নির্দেশ পাঠানো কতটা সমীচীন?

মানিকবাবু বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী ঠিক কী বলেছেন, তা না-শুনে এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE