কাঁকসার সরস্বতীগঞ্জে হাতিটির দেহ পোড়ানো চলছে।
একে পাশের জেলা থেকে আচমকা ঢুকে পড়া হাতির দলের হামলায় প্রাণ গিয়েছে চার জনের, তার উপরে মারা গিয়েছে তাণ্ডব-ক্লান্ত দাঁতালটিও। সবমিলিয়ে হাতি খেদানো, বন দফতরের গাফিলতির অভিযোগে তেতে উঠেছে বর্ধমান। সঙ্গে হাতির হামলায় মৃতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবিতেও সরব হয়েছেন বিরোধীরা।
রবিবার হাতির হামলায় ভাতারের নসিগ্রামের আনন্দময়ী রায় ও নারায়ণচন্দ্র মাঝির অঘোরে প্রাণ যায়। ওই দু’জনকে মেরে হাতিটি খেত জমি ধরে মন্তেশ্বরের বাঘাসন এলাকায় পৌঁছয়। সেখানে জমিতে কাজ করছিলেন কাটোয়ার চন্দ্রপুরের প্রকাশ বয়রা। তাঁকে আছাড় মেরে পা দিয়ে পিষে সামনের দিকে এগিয়ে যায় দাঁতালটি। পথে সামনে পড়ে যান ফিরোজ শেখ। তাঁকেও একই কায়দায় মেরে ফেলে হাতিটি। ততক্ষণে হাতির তাণ্ডবে নিরাপত্তাহীনতা, প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ তুলে মন্তেশ্বরের দু’জায়গায় পথ অবরোধ শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বন দফতরের তরফেও পুলিশ বাহিনী এনে উত্তেজিত, কৌতুহলী জনতার থেকে হাতিটিকে দূরে রাখার চেষ্টা চলছে। যদিও দাঁতালটি বাগ মানেনি। বন দফতরের জেলার কর্তারা জানিয়েছিলেন, এরপরেই ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয় হাতিটিকে।
বর্ধমান মেডিক্যালে গলসিতে হাতির হানায় মৃত অনিলবাবুর পরিজনেরা।
স্থানীয় সূত্রে খবর, সন্ধ্যা নাগাদ অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়ে হাতিটি। সঙ্গে ছোট হাতিটিকে অন্যত্র সরিয়ে দেয় হুলা পার্টি। সরিয়ে দেওয়া হয় কৌতুহলী ভিড়ও। পরে জানা যায়, রাতেই মৃত্য হয় দাঁতালটির। স্থানীয় বাসিন্দা ও বিরোধীদের অভিযোগ, বন দফতরের গাফিলতিতে ঘুমের ওষুধের অতিরিক্ত প্রয়োগেই মারা গিয়েছে হাতিটি। যদিও বন দফতরের কর্তারা তা মানতে চাননি। তাঁদের দাবি, দু’দিনের টানা তাণ্ডবে শরীর জলশূন্য হয়ে গিয়েছিল। তা থেকেই বিপদ ঘনায়। আবার সোমবার সকালে গলসি থেকে বাঁকুড়ার জঙ্গলে ফেরার পথে দামোদরের ধারে কাশপুর গ্রামে অনিল বাগদি (৫০) নামে এক চাষিকে আছড়ে মারে একটি হাতি। ক্ষোভ বাড়ে আরও।
বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার পাত্রসায়র থেকে দামোদর পেরিয়ে সাত জনের একটি হাতির দল গলসি এলাকায় চলে আসে। শনিবার বর্ধমানের কাছে চান্ডুল গ্রামে সাতটি হাতির দলকে দেখা যায়। ওই দিন সকালে কুড়মুনের চন্দনপুরের আপেল মুর্মু চান্ডুল গ্রামে খেত জমিতে কাজ করছিলেন, সেই সময় হাতি তাঁকে আছড়ে ফেললে সে আহত হয়। এর পর থেকে একটি পূর্ণ বয়ষ্ক হাতি ও একটি ছোট হাতি ভাতার হয়ে মন্তেশ্বরের দিকে চলে যায়। আর পাঁচ দলের হাতিটি গলসি-বর্ধমান এলাকাতেই ঘুরতে দেখা যায়। পুলিশ জানিয়েছে, পাঁচটি হাতির দল সোমবার সকালে খেতজমি ধরে বাঁকুড়া যাচ্ছিল। কাশপুরে একটি জমিতে তিল চাষ করছিলেন অনিল বাগদি সহ দু’জন। আচমকা হাতি দেখে খেত জমি থেকে দু’জন ছুট লাগায়। কিন্তু অনিলবাবু হাতির সামনে পড়তেই বেঘোরে মারা যান।
এত দিন পাশের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমে এমনকী, জেলার আউশগ্রামে হাতির হানার খবর মিলত। এ বার একেবারে ভাতার হয়ে মন্তেশ্বর অবদি হাতি পৌঁছে যাওয়ায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন স্থানীয় অনেকেই। ক্ষতিপূরণের দাবিও ওঠে। বামফ্রন্টের প্রাক্তন মুখ্য সচেতক, সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সৈয়দ মহম্মদ মসিহের অভিযোগ, “বন দফতর ও প্রশাসনের গাফিলতিতে বেঘোরে চার জনের প্রাণ গেল। আবার হাতিকে বাগে আনতে না পেরে বন দফতর মেরে ফেলল। জঙ্গলে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় কোনও ব্যবস্থাই তো নিতে পারেনি বন দফতর।” সিপিএমের মন্তেশ্বর ৩ লোকাল কমিটির দফতরে বসে মেমারি ২ জোনাল কমিটির সদস্য সুশান্ত মণ্ডলেরও প্রশ্ন, “চার জন মারা গেলেন বলে বন দফতরকে দেখা গেল! তিন দিন ধরে তাঁরা কোথায় ছিলেন?” পাশে বসে থাকা ওই লোকাল কমিটির সম্পাদক আব্দুল হামিদ কিংবা সিপিএমের ভাতারের প্রার্থী বামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “সরকারি নিয়ম মেনে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে।” ভাতার বাজারে ক্ষতিপূরণ চেয়ে সিপিএমের কৃষক সংগঠন কৃষক সভার পোস্টারও চোখে পড়ে। তৃণমূলের ভাতার ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ নারায়ণ হাজরা চৌধুরীও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন।
ক্ষোভ জানিয়েছেন মৃতের পরিজনেরাও। সোমবার দুপুরে নাসিগ্রামের নারায়ণ মাঝি ও আনন্দময়ী রায়ের পরিজনেরা জানান, রবিবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বাড়িতে এসেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা রামকৃষ্ণ রায় বলেন, “দু’টি পরিবারই দুঃস্থ পরিবার। সরকারের উচিত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।” নারায়ণবাবুর স্ত্রী শ্যামলীদেবীর প্রশ্ন, “সবাই আসছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে, কিন্তু কী ভাবে আমাদের চলবে বলতে পারেন?” আনন্দময়ীদেবীর এক মেয়েও বলেন, “আমরা জঙ্গলমহলে থাকি না। তাও আমাদের গ্রামে দু’জন হাতির হামলায় মারা গেল। ভাবতেই অবাক লাগছে।” কাটোয়ার চন্দ্রপুরের হাতির হামলায় মৃত প্রকাশ বয়রার স্ত্রী করুণাদেবী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “বন দফতর সঠিক সময়ে এলে তো কেউ মারা যেত না। আমাদের মত গরিব মানুষদেরই মৃত্যু হল। এ বার কী ভাবে সংসার চলবে?” মৃতের পরিজনদের একাংশ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “গলসি থেকে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত হাতি খেত জমি নষ্ট করে নাসিগ্রাম হয়ে মন্তেশ্বরের মালডাঙা চলে এসেছিল। কিন্তু বন দফতর ঘুমিয়েই ছিল। জেগে যখন উঠল, ততক্ষণে চারটে মানুষের প্রাণ চলে গিয়েছে!”
বন দফতরের কোনও কর্তাই অবশ্য গাফিলতির কথা মানতে চাননি। শাসকদলের বর্ধমান (গ্রামীণ) সভাপতি স্বপন দেবনাথ বলেন, “বন দফতর চেষ্টা করেছে।”
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy