Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বার বার অভিযান চালিয়েও নাকি মেলে না শিশু শ্রমিক

তথ্য জানার আইনে জেলায় চিঠি পাঠিয়ে শিশু শ্রমিকদের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়। জানতে চেয়েছিলেন, শিশু শ্রমিক উদ্ধারে অভিযান হয় কি না, গ্রাম পঞ্চায়েতের উন্নয়ন সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয় কি না, এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে সচেতনতা শিবির হয় কি না। জবাব পেয়ে দীপকবাবু বেশ হতাশ।

দিন বদলায় না। হাড়ভাঙা খাটুনির আড়ালে এ ভাবেই প্রতি দিন একটু একটু করে খুন হয়ে যায় শৈশব। নিজস্ব চিত্র।

দিন বদলায় না। হাড়ভাঙা খাটুনির আড়ালে এ ভাবেই প্রতি দিন একটু একটু করে খুন হয়ে যায় শৈশব। নিজস্ব চিত্র।

বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০২:২২
Share: Save:

তথ্য জানার আইনে জেলায় চিঠি পাঠিয়ে শিশু শ্রমিকদের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়। জানতে চেয়েছিলেন, শিশু শ্রমিক উদ্ধারে অভিযান হয় কি না, গ্রাম পঞ্চায়েতের উন্নয়ন সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয় কি না, এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে সচেতনতা শিবির হয় কি না। জবাব পেয়ে দীপকবাবু বেশ হতাশ। কেন? দীপকবাবুর কথায়, “উত্তর অসম্পূর্ণ। অনেক প্রশ্নের উত্তর কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেশিয়াড়িতে না কি ২০১১-’১২ সালে ৪২ বার, ২০১২-’১৩ সালে ৪৫ বার উদ্ধার অভিযান চালানো হয়েছে। অথচ, এক জনও শিশু শ্রমিক উদ্ধার হয়নি। এটা বিশ্বাসযোগ্য?’’
আজ, ১২ জুন। শিশুশ্রম বিরোধী দিবস। এই উপলক্ষে হয়তো জেলার নানা প্রান্তে কিছু কর্মসূচি হবে। কিন্তু জেলার নানা প্রান্তে ইটভাটা, কাঠ চেরাই কারখানা, পাথর খাদানে কাজ করা শিশু শ্রমিকদের হাল কি তাতে ফিরবে? জেলায় সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প চালু হয়েছে। শিশু কল্যাণ সমিতি, শিশু সুরক্ষা সমিতিও রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষায় প্রশাসনের কোনও হেলদোলই নেই। পশ্চিম মেদিনীপুরের শিশু কল্যাণ সমিতির (সিডব্লুসি) চেয়ারম্যান শশাঙ্ক পাত্র অবশ্য বলেন, ‘‘হেলদোল নেই, এটা ঠিক নয়। শিশু শ্রমিকদের উদ্ধার করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। শিশুশ্রম রোধ করার চেষ্টাও করা হয়। এ জন্য ব্লকে ব্লকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কিছু পদক্ষেপ ফলপ্রসূও হয়েছে।’’ তাঁর মতে, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। সমিতির অন্য এক সদস্যের কথায়, ‘‘শুধু মুখে বললেই তো আর হবে না! লিখিত অভিযোগ করতে হবে! তবেই শিশু শ্রমিকদের উদ্ধারে পদক্ষেপ করা হবে!’’

বাস্তব হল শিশু শ্রমিকদের উদ্ধার করে পুনর্বাসনে প্রশাসনের চরম উদাসীনতা রয়েছে। লেখাপড়া, আঁকা, নাচ-গান, নাটক শিখিয়ে যত্ন ও সুরক্ষার সঙ্গে শিশু শ্রমিকদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকলের পাশে থাকাটাও জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্য জেলায় সেই সচেতনতা নেই। ১০৯৮ নম্বরে ফোন করে পথ শিশুদের সম্পর্কে খবর দেওয়া যায়। কিন্তু এটাই বা ক’জন জানে? শিশু সুরক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে আরও প্রচার জরুরি। জেলার শিশু কল্যাণ সমিতির এক সদস্যের অবশ্য দাবি, ‘‘আমাদের কাছে খবর এলে আমরা শিশু শ্রমিকদের উদ্ধার করে তাদের ভাল ভাবে গড়ে তোলার সব রকম চেষ্টা করি। প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপও করা হয়।’’

পশ্চিম মেদিনীপুরেও যে শিশুশ্রম রমরমিয়ে চলছে, তার প্রমাণ মিলেছে পিংলা বিস্ফোরণের ঘটনায়। গত ৬ মে পিংলার ব্রাহ্মণবাড়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে ৯ জনই নাবালক। ১৯৯৬ সাল থেকে শিশুশ্রম বন্ধে আইন চালু করে কেন্দ্র। জানানো হয়, ১৫টি জীবিকা ও ৫৭টি পেশা শিশুদের পক্ষে বিপজ্জনক। সেই সময় দেখা গিয়েছিল, দেশে প্রায় দেড় কোটি শিশু শ্রমিক রয়েছে। এ রাজ্যে প্রায় দু’লক্ষ। ওই সময় থেকে অন্য জেলার পাশাপাশি এ জেলাতেও শিশু শ্রমিক স্কুল গড়ে ওঠে। পশ্চিম মেদিনীপুরে ৪২টি শিশু শ্রমিক স্কুল রয়েছে। এই সব স্কুলে বছরে গড়ে ১,৮০০ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। কিন্তু, এর বাইরে থেকে গিয়েছে অনেক শিশু শ্রমিকই। যাদের শৈশব যেন কম বয়সেই হারিয়ে গিয়েছে। কেউ সাইকেল মেরামতের কাজ করে। কেউ দোকানে কাজ করে। কেউ বা বাড়ি তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত। কেন শৈশবেই রোজগারের ঠিকানা খুঁজে নিতে হয়েছে? মেদিনীপুরের এক শিশু শ্রমিকের জবাব, ‘‘কাজ না করলে কী চলবে? তাই পড়াশোনা ছেড়েছি।’’

এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তার কথায়, ‘‘শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসনের তত্‌পরতার অভাব রয়েছে। সরকারি প্রকল্প রয়েছে। যাতে শিশু শ্রমিকদের পরিবারও উপকৃত হবে। অবশ্য তা রূপায়ণ হয় না! জেলায় এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই নেই!’’ তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল রয়েছে। কিন্তু তাহলেই কী সব হয়ে যায়? শিশু শ্রমিকদের উদ্ধার করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা তো করতে হবে।’’ অভিযোগ, শিশু সুরক্ষা বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। অনেক অনিয়মও চোখে পড়ে। তা-ও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। শিশু সুরক্ষায় প্রতি ব্লকে যে কমিটি রয়েছে, সেই কমিটিগুলোও খুব সক্রিয় নয়।

আর তাই পিংলার মতো ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারাতে হয় আমির শেখ, রাহুল শেখ, সামিম শেখদের মতো নাবালকদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE