Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
একুশের মঞ্চে ভোটের সুর

সিন্ডিকেট বা খাদান নয়, বার্তা ভাবমূর্তি উদ্ধারে

‘‘ইউ মে গেট আউট!’’ শৃঙ্খলা রক্ষায় বারবারই দলীয় কর্মীদের সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু একের পর এক ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ায় বিড়ম্বনা বেড়েছে তৃণমূলের। এ বার বিধানসভা ভোটের দিকে লক্ষ্য রেখে দলে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে কড়া বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মঞ্চে ভাইপো অভিষেকের সঙ্গে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

মঞ্চে ভাইপো অভিষেকের সঙ্গে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

রোশনী মুখোপাধ্যায় ও দেবারতি সিংহচৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

‘‘ইউ মে গেট আউট!’’

শৃঙ্খলা রক্ষায় বারবারই দলীয় কর্মীদের সংযত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু একের পর এক ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ায় বিড়ম্বনা বেড়েছে তৃণমূলের। এ বার বিধানসভা ভোটের দিকে লক্ষ্য রেখে দলে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে কড়া বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার ‘শহিদ সমাবেশে’র মঞ্চ থেকে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি তৃণমূল নেত্রীর সাফ কথা, সিন্ডিকেট ব্যবসা বা খাদান থেকে টাকা তুলতে গেলে তৃণমূল করা যাবে না!

জেলায় জেলায় সিন্ডিকেট-ব্যবসা এবং খাদান থেকে টাকা তোলা, তার জেরে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ, এমনকী প্রাণহানির ঘটনাতেও নাম জড়িয়েছে তৃণমূলের। বিধানসভা ভোট যত কাছাকাছি আসছে, ততই এই ধরনের ঘটনা বাড়ছে। রাজারহাট-নিউটাউন যার বড় উদাহরণ। যেখানে সিন্ডিকেট ঘিরে সংঘর্ষ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিউ টাউন থেকে বেরিয়ে শহরের অন্যত্রও সিন্ডিকেটের জেরে অপরাধ-চক্র সক্রিয় হয়ে উঠছে। এ সবের সঙ্গে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের নাম জড়িয়ে জনমানসে ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হচ্ছে, তা বুঝেই মমতা এ দিন নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে স্পষ্ট বলেছেন, ‘‘আমি তৃণমূলে কোনও বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করব না!’’

বালি, সিমেন্ট-সহ ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসার সিন্ডিকেটের জন্য নানা এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের খবর শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে আসছে অনবরত। দলীয় বিধায়ক, সাংসদদের নাম জড়ানোয় তাঁদের আলাদা ভাবে ডেকে মমতা অতীতে তাঁদের সতর্কও করেছেন। কিন্তু সমস্যা মেটেনি। বিধানসভা ভোটের আগে তাই সিন্ডিকেট-রাজ থেকে তৃণমূলকে বিরত রাখতে মমতার হুঁশিয়ারি, ‘‘কেউ যদি সিন্ডিকেট করতে চান, সিন্ডিকেট করুন। সিন্ডিকেট করলে দল করা যাবে না!’’ একই ভাবে বর্ধমান, বাঁকু়ড়া বা বীরভূমের মতো জেলায় খাদান থেকে টাকা তোলা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। দলের অন্দরে তার জন্য সংশ্লিষ্ট নেতাদের সতর্ক করা হয়েছে আগেই। এ বার শহিদ দিবসের প্রকাশ্য মঞ্চ থেকেই দল সামলাতে তৃণমূল নেত্রীর হুঁশিয়ারি, ‘‘খাদানের টাকা দরকার হলে খাদানই করুন! দয়া করে তৃণমূল আর করবেন না!’’


২১-এর মঞ্চে তারকার মেলা। মঙ্গলবার ধর্মতলায় সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

মমতার এই নির্দেশে কাজ হবে কি না, তা নিয়ে বিরোধীরা অবশ্য সন্দিহান। আগেও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে বাস্তবের ছবি বদলায়নি। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ যে কারণে মন্তব্য করেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তোলাবাজি চলবে না। গত বারও বলেছিলেন প্রোমোটারি চলবে না। তার পরে এই এক বছরে তোলাবাজি, প্রোমোটারি সংক্রান্ত গোলমালে ওঁর দলেরই অনেকে খুন হয়েছেন!’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূলে যে দিন সিন্ডিকেটের জায়গা হবে না, সে দিন তৃণমূলে ওঁরও (মমতা) স্থান হবে না। কারণ, ওঁর ছত্রচ্ছায়াতেই সব সিন্ডিকেট হয়েছে!’’

অনুশাসনের বার্তা নিষ্ফলা থেকে যাওয়ার নজির যে হেতু বহু, তাই তৃণমূলের ঘরেই সংশয় আছে ঘরপোড়া অনেকের! সিন্ডিকেট, খাদান-তোলাবাজির সঙ্গেই গত চার বছরে শাসক দলের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে হামলা এবং শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও বারই কড়া শাস্তির নির্দেশ না দিয়ে অনেক সময়ই ‘ছোট ছেলেদের কাণ্ড’ বা ‘দুষ্টুমি’, ‘ছোট ঘটনা’ বলে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়েছেন মমতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনার পরে নানা মহল থেকে সমালোচনার মুখে ভোটের আগে দলের ছাত্র-যুবদের আরও সংযত করতে এ দিন তাঁকেই পরামর্শ দিতে হয়েছে, ‘‘দামাল ছেলেরা লড়াই করে। আবার দুষ্টুমিও করে। তবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্মান করতে হবে। বড়দের সম্মান দিতে হবে। সামনে বড় কাউকে দেখলে চেয়ার ছেড়ে দিতে হবে।’’


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

গোষ্ঠীর বদলে মানুষের স্বার্থেই যে কাজ করতে হবে, এ দিন নেতা-কর্মীদের সেই বার্তাও দিতে হয়েছে তৃণমূল নেত্রীকে। বুঝিয়েছেন, ব্যক্তিস্বার্থে দলের পতাকা ব্যবহার করা বরদাস্ত করবেন না। ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে যাঁরা দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন, তাঁদের দল থেকে তাড়ানোর হুঁশিয়ারিও দেন। শৃঙ্খলার অনুশাসনে দলের সব স্তরকে সাজিয়ে নিতে সেই পাঁচ ‘ডি’-র সূত্রই ফের দিয়েছেন মমতা। বলেছেন, ‘‘পাঁচটা ‘ডি’ চাই আমি। শৃঙ্খলা (ডিসিপ্লিন), নিষ্ঠা (ডেডিকেশন), ভক্তি (ডিভোশন), প্রতিজ্ঞা (ডিটারমিনেশন) এবং উন্নয়ন (ডেভেলপমেন্ট)।’’

বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু অবশ্য এর সঙ্গে অন্য একটি ‘ডি’ জুড়েছেন। তাঁর তির্যক মন্তব্য, ‘‘উনি নিজেই কোনও শৃঙ্খলা মানেন না। যেখানে রাস্তার উপরে সভা করার কথা নয়, উনি সেখানেই সভা করেন!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘ওঁর ডি মানে ডেস্ট্রাকশন। সব কিছু ধ্বংস করো!’’

শৃঙ্খলারক্ষার বার্তা দিতে গিয়ে তাঁর বক্তৃতায় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করেছেন মমতা। দলকে ভালবেসে, মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করার পরামর্শ দিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, ‘‘সংযত, সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে।’’ অনুশাসনের নির্দেশ দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই সভামঞ্চের সামনের জনস্রোতকে সামান্য বিশৃঙ্খল হতে দেখলেই কড়া ভাষায় এ দিন সতর্কও করেছেন মমতা। বক্তৃতা থামিয়ে কখনও বলেছেন, ‘‘কারা এমন করছে?আমি কিন্তু প্রত্যেকটা মুখ সিসিটিভি-তে দেখব! মুখগুলো দেখে আমি কিন্তু ব্যবস্থা নেব।’’ কখনও কড়া সুরেই ধমক দিয়ে জনতাকে শান্ত হয়ে বসে পড়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘‘বিশৃঙ্খলা তরুণ প্রজন্মই করছে দেখছি! আমি শৃঙ্খলা পছন্দ করি।’’ সভায় আগত জনস্রোতের মধ্য থেকে ‘বিশৃঙ্খল’ মুখ চিহ্নিত করে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কারের হুমকিও দিয়েছেন। কর্মীরা সংযমী ও সুশৃঙ্খল থাকলে তার সুফল যে দল পাবে, তা বোঝাতেই মমতাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘নেতা গাছ থেকে পড়ে না! আন্দোলন থেকে নেতা তৈরি হয়। আমি চাই তেমনই নেতা, যে মানুষের পাশে থেকে মানুষের কাজ করবে।’’

মমতার আগে দলের বর্ষীয়ান নেতা ও সাংসদ সৌগত রায়ও একই ভাবে কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘আমাদের বহু কর্মীর প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে দল ক্ষমতায় এসেছে। মাথায় রাখতে হবে, তৃণমূলের পতাকা হাতে নিয়ে কোনও অন্যায় যাতে না হয়।’’ আবার দলের তরুণ ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও কৌশলে বার্তা দিয়েছেন কথা ও কাজে সংযম রাখার। তাঁর কথায়, ‘‘বন্দুক থেকে বেরিয়ে যাওয়া গুলি, মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কথা আর চলে যাওয়া সময় ফেরানো যায় না!’’

দলের জন্য যাঁরা ভাল কাজ করবেন, ভোটবাক্সে ফসল তুলে দেবেন, তাঁদের যে কদর বাড়বে, তার নমুনাও মঞ্চে দেখা গিয়েছে। কলকাতা পুরভোটে দলের সাফল্যের জন্য কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে মঞ্চে সামনে ডেকে আলাদা করে কৃতিত্ব দিয়েছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE