Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Rituals

জন্মাষ্টমীতে নবজন্ম, লোকাচার ও ঐতিহ্যে

বেলজিয়াম কাচের ফানুস আর মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোয় সাবেক পরিবেশে জন্মাষ্টমী উদ্‌যাপিত হয় মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসে। পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আটটি ধাপ।

শোভাবাজার রাজপরিবারের বড় তরফের গৃহদেবতা গোবিন্দজিউ।

শোভাবাজার রাজপরিবারের বড় তরফের গৃহদেবতা গোবিন্দজিউ।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৭ ০০:৩০
Share: Save:

ঝুলনযাত্রার রেশ কাটতে না কাটতে‌ই আসমুদ্রহিমাচল উদ্‌যাপিত হয় জন্মাষ্টমী। জন্মাষ্টমী যেন ভক্তের কাছে শ্রীকৃষ্ণের নবজন্ম। তাই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ, ভক্তি ও ভালবাসা। ব্রজভূমিতে ঝুলন থেকেই শুরু হয়েছে উৎসব। পিছিয়ে নেই বাংলাও। বাঙালির জন্মাষ্টমীতে রয়েছে নিজস্ব কিছু আচার অনুষ্ঠান ও প্রথা। কলকাতার বনেদি পরিবার থেকে মঠ মন্দির, কিংবা মফসসলেও দেখা যায় ভিন্ন মেজাজ। কোথায় দেবতার উদ্দেশ্যে দেখা যায় নাড়ি কাটা অনুষ্ঠান কোথাও বা ভোগের এলাহি আয়োজন। এ যেন দেবতার সঙ্গে ভক্তের আত্মিক যোগাযোগ।

বেলজিয়াম কাচের ফানুস আর মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোয় সাবেক পরিবেশে জন্মাষ্টমী উদ্‌যাপিত হয় মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসে। পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আটটি ধাপ। গৃহদেবতা জগন্নাথ, গোপাল, গোপিচাঁদবল্লভের সামনে নারায়ণ শিলার উপরে অনুষ্ঠিত হয় জন্মাষ্টমীর বিশেষ পুজো। প্রথমে দুধ, দই ঘি মধু গঙ্গাজল, তুলসী, চন্দন দিয়ে দেবতার অভিষেক করা হয়। ব্রাহ্মণরা পাঠ করেন শ্রীকৃষ্ণের কীর্তি জন্মবৃত্তান্ত। পরিবারে অন্যতম সদস্য হীরেন্দ্র মল্লিক বলছিলেন, জন্মাষ্টমী নিয়ে পরিবারে প্রচলিত একটি শ্লোক।

‘পোস্ত মটর মুগ মরিচ বরবটি ছোলা শুঁটি পিঁপলি কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী,

সান্ধ্য অভিষেকে সিক্তবসন, সূচী তুলসীস্নান দেখে ভক্তজন,

ব্রাহ্মণ পাঠে রত কত সুখ কীর্তি তব কদম্বকামিনী তলে দোলে শ্যামরাই

লীলা করে ভক্তমাঝে, অসংখ্য বিচিত্র নব সাজে ঝুলের অবসানে

নব জন্ম আবেশে জন্মাষ্টমী সমাগম অভিষেক উদ্মন।’

এখানে জন্মাষ্টমীর ভোগে থাকে পোস্ত, মটর, মুগ, মরিচ, বরবটি, ছোলা, শুঁটি, পিঁপলি ভাজা। এর সঙ্গে থাকে ঘি, রাবড়ি লুচি, তালের বড়া। রুপোর থালায় এ সব দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়।

আরও পড়ুন: যে জন আছে মাঝখানে

জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যায় শোভাবাজার রাজপরিবারের বড় তরফের গৃহদেবতা গোবিন্দজিউর ষোড়শোপচারে বিশেষ পুজো ও হোম হয়। এই উপলক্ষে গোবিন্দজিউকে নতুন কাপড় ও অলঙ্কার পরানো হয়। পুজোয় দেওয়া হয় তাল সহ বিশেষ নৈবেদ্য। পর দিন জাঁকজমক সহকারে পালন করা হয় নন্দোৎসব। অতীতে আরও জাঁকজমক সহকারে জন্মাষ্টমী হত। আগে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা রং চং মেখে মুকুট গয়না পরে নন্দ সাজত। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখাতো। এই উপলক্ষে একটা বড় জালায় আগে হলুদ গুলে সেটা সবার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হত। কাউকে কাউকে স্নানও করিয়ে দেওয়া হত। এখন পুরোহিত মশাই সেই হলুদ জল ছিটিয়ে দেন। এ দিনও নতুন করে গোবিন্দজিউকে সাজানো হয়। আগে আসতেন কিছু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা নাম সংকীর্তন করতেন। সেই দিনও বিশেষ পুজোর পরে ভোগ আরতি হয়। এখনও গোবিন্দজিউর ভোগে থাকে খাস্তাকচুরি রাধাবল্লভী, গজা, নিমকি, বালুসাই, লালমেঠাই, মতিচূর তালের বড়া ইত্যাদি। আগে জন্মাষ্টমীতে ছ’টি রুপোর মুদ্রা উৎসর্গ করা হত। এখন তার পরিবর্তে ছ’টাকা উৎসর্গ করা হয়।


মধ্য কলকাতার গোবিন্দ সেন লেনে চুণিমণি দাসীর গৃহদেবতা গোবিন্দদেবজিউ।

দর্জিপাড়া রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে গৃহদেবতা নারায়ণ শিলা রাজরাজেশ্বরের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ষোড়শপচারের বিশেষ পুজো হয়। পুরনো প্রথা অনুসারে সদ্যোজাত ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যেমন তার নাড়ি কাটা হয় তেমনই গৃহ দেবতার উদ্দেশ্যে হলুদ সুতো কাটা হয় চাঁচারি দিয়ে। যাতে তাড়াতাড়ি নাড়ি শুকোয় সেই জন্য দেওয়া হয় আদার শোঁট। বিশেষ ভোগে থাকে তালের লুচি, তালের বড়া, লুচি, নানা রকম ভাজা।

মধ্য কলকাতার গোবিন্দ সেন লেনে চুণিমণি দাসীর বাড়িতে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে গৃহদেবতা গোবিন্দদেবজিউর উদ্দেশ্যে সন্দেশের তৈরি কেক কাটা হয়। যদিও পরিবার সূত্র জানা গিয়েছে এই প্রথাটি খুব একটা পুরনো নয়। জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যায় রাধাগোবিন্দদেব জিউর দারু বিগ্রহ সিংহাসন থেকে ঠাকুরদালানে বের করে এনে দুধ, মধু আতর দিয়ে স্নান করানো হয়। এর পরে নতুন বস্ত্র পরিয়ে সাজসজ্জ্বা করিয়ে বিশেষ পুজো করা হয়। সে দিন ভোগে থাকে লুচি, সুজি, নানা রকম ভাজা, তরকারি তালের বড়া, মিষ্টি ইত্যাদি। পরের দিন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি তিনি একটি হাঁড়িতে দই আর হলুদ নিয়ে সাত বার উঠোন প্রদক্ষিন করার পরে সেই হাঁড়িটি ফাটানো হয়। সে দিন পায়েস ভোগ দেওয়া হয়।


পোস্তা রাজবাড়ির গৃহদেবতা শ্যামসুন্দর জিউ।

পোস্তা রাজবাড়ির গৃহদেবতা শ্যামসুন্দর জিউর বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা সুখময় রায়। বর্তমান ঠাকুরবাড়িটি ১৫০ বছর আগে তৈরি করেছিলেন রাজকুমার রায়। জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসব আজও সাড়ম্বরে পালন করা হয় রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিটে শ্যামসুন্দর জিউর ঠাকুরবাড়িতে। জন্মাষ্টমীর দিনে আঁতুর ঘরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মানুষ্ঠান, নাড়িকাটা ইত্যাদি হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে কংসের হাত থেকে সদ্যোজাত কৃষ্ণকে রক্ষা করতে রাখা হয় একটি ঢাল ও তরোয়াল। পুজোয় হয় বিশেষ হোম। ভোগে থাকে লুচি, ভাজা, মালপোয়া, সন্দেশ, দরবেশ, নানা ধরনের মিষ্টি। পরের দিন হয় নন্দোৎসব। সেই উপলক্ষে বিগ্রহকে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়। তবে নন্দোৎসবের আর এক তাৎপর্য রাধারানির মানভঞ্জন। সকালে রাধারানিকে দোতলায় একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেলে শ্যামসুন্দর তাঁকে ভেট পাঠান। পরে রাধারানির মানভঞ্জনের জন্য শ্যামসুন্দরকেও দোতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় পরিবারের সদস্যরা একটি গান করেন যা পরিবারে প্রচলিত। পরে রাধিকার মানভঞ্জনের পরে যুগল মূর্তিকে এক সঙ্গে নীচে দালানে এনে সিংহাসনে স্থাপন করে আরতি করা হয়। এই সময়ে নিবেদন করা হয় তালের বড়া, মালপোয়া ভোগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE