Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Erosion

ভাঙনের মাটি আনছি গড়তে

মাহেশ্বরী যে ফাটলটার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন আর কথা বলছিলেন ছেলে রবির সঙ্গে, তার পিছনেই একটা বাড়ি। উঠোন-দাওয়া, উঠোনের পাশে গাছ। গাছের সামনে মালপত্র গোছানো। গঙ্গা এগোচ্ছে ক্রমশ। গেরস্থালির জিনিস জমা করে অন্যত্র আশ্রয়ের খোঁজে পিছোচ্ছেন সকলে।

ভাঙন: গঙ্গার পাড় ভাঙছে সান্যালচর গ্রামে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ভাঙন: গঙ্গার পাড় ভাঙছে সান্যালচর গ্রামে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:৩০
Share: Save:

‘‘আগের বাড়িটা কোথায় ছিল?’’, ছেলের প্রশ্ন মাকে।

উত্তর এল, ‘‘মনে নেই আর।’’

কিছু ক্ষণ চুপ দু’জনেই।

‘‘মা, এ দিকে দেখো, আর একটা ফাটল হয়েছে। তার মানে এ বার এই জায়গাটা থেকে যাবে।’’ বলল ছেলে।

মা নিরাসক্ত, ‘‘কতই তো গেল! নতুন কী!’’

যেখানে গঙ্গা স্রোতস্বিনী, সেই জায়গাটা দেখিয়ে মাহেশ্বরী বিশ্বাস বললেন, ‘‘আগে আমাদের গ্রাম ওখানে ছিল। সান্যালচর, বসতিপাড়া, ফকিরপাড়া, বর্গিপাড়া, অনেক গ্রাম। সব গিলেছে গঙ্গা।’’

গঙ্গা আড়াআড়ি ভাবে চলে গিয়েছে মাঝ-বরাবর। এ প্রান্তে নদিয়া, ও প্রান্তে হুগলি। আর যেতে-যেতে দুই প্রান্তেরই মাটি বুভুক্ষের মতো গিলেছে গঙ্গা। তাই নদিয়ার চাকদহের সান্যালচরের গঙ্গা ঘোলাটে। এখন যেখানে গঙ্গার ঘোলাটে স্রোত বয়ে যাচ্ছে, সেখানে একসময় বাজার ছিল, স্কুল ছিল। গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৩টা ওয়ার্ডও ছিল। এখন মাত্র চারটে ওয়ার্ড পড়ে রয়েছে!

‘‘এই যে দেখছেন গাছ কাটা হচ্ছে, সমস্ত জিনিস গোছানো হচ্ছে, যাওয়ার তোড়জোড় চলছে। আর কিছু দিনের মধ্যে এই জায়গাটাও তো জলের পেটে,’’ মাহেশ্বরী বলছিলেন। মাহেশ্বরী যে ফাটলটার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন আর কথা বলছিলেন ছেলে রবির সঙ্গে, তার পিছনেই একটা বাড়ি। উঠোন-দাওয়া, উঠোনের পাশে গাছ। গাছের সামনে মালপত্র গোছানো। গঙ্গা এগোচ্ছে ক্রমশ। গেরস্থালির জিনিস জমা করে অন্যত্র আশ্রয়ের খোঁজে পিছোচ্ছেন সকলে।

যেমন মাহেশ্বরীও বেঁচে থাকার সম্বল নিজের চায়ের দোকান নিয়ে পিছোতে থাকেন। ‘‘ষোলোবার দোকান সরিয়েছি। অনেক সময় রাতে উঠে দেখতে আসি, দোকানটা আছে না কি চলে গিয়েছে।’’

সান্যালচরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখে বোঝার উপায় নেই, মাটির সঙ্গে জলের, মানুষের সঙ্গে জলের, সেই সম্পর্ক এখানে ‘প্রাণঘাতী’!

যদিও সেই মাটিতেই প্রতিমা প্রাণ পাচ্ছে গঙ্গার ও প্রান্তে—হুগলির সিজা-খামারগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতে। ফেরি করে ও প্রান্তে যেতে বড়জোর ১০ মিনিট লাগে। আধ ঘণ্টা অন্তর ফেরি পরিষেবা। ভোর-ভোর শুরু হয় ফেরি চলাচল। চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। সারাদিনে ২০০-২৫০ লোক যাতায়াত করেন। আগে দু’টাকা ভাড়া ছিল। এখন তিন টাকা হয়েছে। সেখানকারই এক কারখানায় গঙ্গার মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে একের পর এক প্রতিমা। মালিক অর্চনা পাল বললেন, ‘‘আমাদের দিকটাও তো ভাঙা শুরু হয়েছে। যে জায়গা ভাঙছে, সেখান থেকেই তো মাটি আনছি। তবে সব মাটি তো আর লাগে না। হাত দিয়ে দেখে নিই কোন মাটি লাগে।’’

একটা দুর্গাও কি আসবে মাহেশ্বরীদের গ্রামে?

‘‘গত দু’বছর পুজো হয়েছে। এ বারও হবে। মহালয়ায় কোটালে জল উঠেছিল, তবে নেমে গিয়েছে। জল নেমেছে দেখে পুজোয় একটা জামাকাপড়ের দোকান দিয়েছি।’’ গঙ্গার এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন মাহেশ্বরী।

রবি এতক্ষণ চুপচাপ কথা শুনছিলেন। হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে যা বললেন, তার সারমর্ম এই, সাত বছর আগের বিশ্বকর্মা পুজোয় মামার ছেলে ও আরও এক বন্ধুর সঙ্গে মাছ ধরতে এসেছিলেন রবি। মামাতো ভাইয়ের হাতে জাল ছিল। মাছ ধরার নেশায় রবিরা খেয়াল করেননি যে গঙ্গা যেখানে বিপজ্জনক, সেখানে তাঁরা চলে এসেছেন। হঠাৎ স্রোতের ঘূর্ণিতে আটকে গিয়েছিল জাল। অন্য প্রান্তে তখন পাড় ভেঙে জালের উপর হুড়মুড়িয়ে মাটি পড়তে শুরু করেছে।

জাল হারিয়ে গেলে বাবা বকুনি দেবেন, এই ভয়ে মামাতো ভাই হাতে গিঁট বেঁধেছিল, যাতে জাল স্রোতে না চলে যায়। মাছ ধরা পরিবারের কাছে জালই তো সম্বল! রবি বলছিলেন, ‘‘পাড় ভেঙে ও মাটির নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল।’’

জন্মলগ্ন থেকে তো গঙ্গা এ ভাবেই উত্তাল। পুরাণ-বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বলেন, ‘‘প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী গঙ্গার যা স্রোত, তাতে সরাসরি মর্ত্যলোকে এলে ধ্বংসের আশঙ্কা আছে, তাই শিব জটায় ধারণ করেছিলেন। আসল কথা হল, যে প্রবল স্রোত নিয়ে গঙ্গা মানস সরোবর থেকে নামে, যাত্রাপথে বিভিন্ন পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অনেকগুলো ভাগ হয়ে যায় মূল থেকে, এটাই তো মহাদেবের জটা। পৌরাণিক জগত থেকে লৌকিক জগৎ যখন বিচার করি, তখন সেটাকে এ ভাবেই বিচার করি।’’

নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম সরকার আবার বলছেন, ‘‘হুগলি ও নদিয়ার মধ্যপ্রান্তে যে চরটা জেগে উঠেছে, তাতে গঙ্গার স্রোত গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। সেই স্রোতই এসে নদিয়ার পাড়ের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করছে।’’

তবে পুরাণের গঙ্গা বা গবেষকদের গঙ্গাকে চেনে না সান্যালচর। এখানে গঙ্গার আগ্রাসন বাড়তে থাকলে সকলে ডাঙার দিকে এগিয়ে যান। আর জলের তলায় ডুবে যায় তৈরি করা ঘর, সংসার-স্মৃতি, কাটানো সময়। অন্যত্র আবার চলতে থাকে জীবনের খোঁজ।

বহুকাল আগে একদম অন্য প্রেক্ষিতে আইরিশ নাট্যকার জে এম সিঙ্গের ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্র সমুদ্রে রুটিরুজির সন্ধানে যাওয়া স্বামী-সন্তানদের একে একে হারানোর পরে বলেছিল, ‘সমুদ্র আমার আর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’

সেই কথায় ছিল সমুদ্রের উপরে রাগ, ক্ষোভ, একই সঙ্গে নিস্পৃহ স্পর্ধা! সেই স্পর্ধাই ফুটে উঠল মাহেশ্বরীর কথায়, যখন তিনি বললেন, ‘‘যা গিয়েছে যাক। পালাব তো না। বাঁচতে তো হবে।’’

সন্ধ্যা নামছে গঙ্গার পাড়ে। গঙ্গার স্রোত ভাঙছে পাড়ে। একটা, দু’টো, তিনটে। পড়ন্ত আলোয় মাহেশ্বরীর চোখে জল, তিরিতির করছে, তবু চোখের পাড় উপচে পড়ছে না, ধাক্কা খাচ্ছে চোখের কিনারে। গঙ্গা, ঢেউ, একটা চায়ের দোকান, প্রান্তিক মানুষ, তাঁদের বাঁচার চেষ্টা, মহালয়ায় গঙ্গা কতটা উত্তাল হবে, সে দুঃশ্চিন্তা—সব মিলেমিশে এক, একাকার ওই পাড়ে ধাক্কা খাওয়া ঢেউয়ে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Erosion River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE