Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সমরেশ নিজে কেনেন মেরুন সেই ট্রলিব্যাগ

ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমরেশ সরকার যে রীতিমতো হিসেব কষেই খুন করেন তাঁর প্রেমিকা সুচেতা চক্রবর্তী এবং চার বছরের ছোট্ট দীপাঞ্জনাকে, ক্রমে সেই ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে পুলিশের কাছে।

বিয়ের সময় সুচেতা। ছবি পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

বিয়ের সময় সুচেতা। ছবি পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

সুব্রত সীট ও প্রকাশ পাল
দুর্গাপুর ও শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৩
Share: Save:

ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমরেশ সরকার যে রীতিমতো হিসেব কষেই খুন করেন তাঁর প্রেমিকা সুচেতা চক্রবর্তী এবং চার বছরের ছোট্ট দীপাঞ্জনাকে, ক্রমে সেই ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে পুলিশের কাছে।

যে মেরুন রঙের সুটকেসে সুচেতার নাভি থেকে শরীরের নিম্নাংশ মিলেছিল, তা সমরেশই কিনেছিলেন। দুর্গাপুরের বেনাচিতি বাজারের যে দোকান থেকে তিনি সুটকেসটি কেনেন, মঙ্গলবার তার কর্মচারী সমরেশকে শনাক্ত করেছেন। দোকানে রশিদের যে কার্বন কপি রয়েছে, সেখানে অন্য নাম থাকলেও রয়েছে সমরেশের মোবাইল নম্বর।

এটা যদি তদন্তে সাফল্যের এক দিক হয়, অন্য দিক হল সুচেতাদের নাড়িভুঁড়ির খোঁজ পাওয়া। এর আগে পুলিশ দুর্গাপুরের বিধাননগর আবাসনে সুচেতার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেছে, সব ধুয়েমুছে সাফ করা। কোথাও কিছু নেই। প্রশ্ন উঠেছিল, তা হলে নাড়িভুঁড়ি গেল কোথায়? কারণ, সুটকেসে সে সব কিছু ছিল না। এ দিন দুর্গাপুরের ওই ভবনে সুচেতার ফ্ল্যাটের পিছনে একটি সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে কাপড়ে-মোড়া নাড়িভুঁড়ি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের সন্দেহ, দেহ থেকে রক্তক্ষরণ কমাতে সমরেশ সুচেতার দেহের ভিতর থেকে ওই অংশগুলি বার করে লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন।

পুলিশ সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, ঘরের ভিতর থেকে বঁটি, চপার, শিল-নোড়া, ঠান্ডা পানীয়ের ফাঁকা বোতল, ঘুমের ওষুধের ফাঁকা ও ভর্তি ‘ফাইল’, তোয়ালে, একটি নাইলনের ব্যাগে রাখা ফাঁকা ফিনাইলের ডজনখানেক বোতলও উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ মনে করছে, চপার ও শিলনোড়া ব্যবহার করে সুচেতার দেহ কাটা হয়। তোয়ালে দিয়ে রক্ত মুছে ফিনাইল দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে ঘরের ফ্যান চালিয়ে, তোয়ালে শুকোতে দিয়ে, দেহাংশ-ভরা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যান সমরেশ।

এ দিন সিআই অসিতবরণ কুইলার নেতৃত্বে পুলিশের ছয় জনের একটি দল সুচেতার ফ্ল্যাটে প্রায় ৫ ঘণ্টা তদন্ত চালান। সেই সময়ে সমরেশ ছিলেন বিধাননগর ফাঁড়িতে। পুলিশ সূত্রে খবর, তাঁকে জেরা করা হচ্ছিল। একই সঙ্গে তাঁর থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখছিল পুলিশ দলটি।

গ্রেফতার হওয়ার দিন থেকে এ পর্যন্ত সমরেশ নানা ভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনও ভুল তথ্য দিচ্ছেন, কখনও স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছেন না। তাঁর বয়ানের ধোঁয়াশা কাটাতে টানা জেরা চলছে। এত দিন সমরেশ দাবি করছিলেন, চার বছরের দীপাঞ্জনাকে তিনি মারেননি। সুচেতাই মেয়েকে জলে চুবিয়ে মেরে ফেলে। এ দিন তিনি স্বীকার করেন, মা ও মেয়ে, দু’জনকে তিনিই জলে চুবিয়ে মেরে ফেলেছেন। পুলিশ সূত্রের খবর, একই সঙ্গে সুচেতাদের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর কথাও মেনে নিয়েছেন তিনি।

তদন্তকারীরা জানতে চান, এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাকে জলে চুবিয়ে মারা কী ভাবে সম্ভব? তিনি বাধা দেননি? তখন সমরেশ দাবি করেন, ‘‘সুচেতা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। তাই আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল।’’ তবে সেই ঘুমের ওষুধ সুচেতা নিজে খেয়েছিলেন, নাকি সমরেশ তাকে খাইয়েছিলেন, সেই ব্যাপারে এখনও তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। পুলিশের সন্দেহ, সম্ভবত ঠান্ডা পানীয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় দু’জনকে।

এ দিন সহকারী ডিরেক্টর শিপ্রা রায়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি ফরেন্সিক দলও সুচেতার ফ্ল্যাটে যায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, নমুনা সংগ্রহ করেন। সমরেশকেও প্রথমে তাঁর ব্যাঙ্কের আবাসনে ঘুরিয়ে পরে বেলা তিনটে নাগাদ সুচেতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সেখানে খুনের ঘটনার পুনর্নির্মাণ করানো হয় সমরেশকে দিয়ে। তার পর দফায় দফায় জেরা সেরে সন্ধ্যা সাতটার পর সমরেশকে নিয়ে বেনাচিতির বাজারে যায় পুলিশ।

পুলিশ এ দিন জানতে পেরেছে, গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ অটো ধরে সমরেশ বেনাচিতি বাজারের একটি দোকানে যান। সেখান থেকে চটপট মেরুন রঙের ট্রলি ব্যাগটি কেনেন ৪৬০০ টাকা দিয়ে। রসিদে নাম ‘এস মুখোপাধ্যায়’ থাকলেও নিজের মোবাইল নম্বরই দেন। পুলিশ দোকানের কর্মচারীকে বাইরে ডেকে গাড়িতে-বসা সমরেশকে দেখালে কর্মচারী তাঁকে শনাক্ত করে।

যে ভাবে সুচেতাকে মেরে টুকরো টুকরো করা হয়েছিল, তা শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত তাঁর আত্মীয়েরা। এখনও ঘটনার কথা ভেবে শিউরে উঠছেন সুচেতার ছোট মাসি সুনীপা পাঠক। মঙ্গলবার সকালে বনগাঁর ট’বাজার এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে বসে তিনি বলেন, ‘‘মাছের রক্ত দেখলেও ভয়ে সিঁটিয়ে যেত ছোট মেয়েটা। সেই মামনকে (সুচেতা) টুকরো টুকরো করে কাটা হয়েছে, ভাবতে পারছি না।’’ ছোটবেলার বেশির ভাগটাই মামাবাড়িতে কেটেছে সুচেতার। সুনীপাদেবী বলেন, ‘‘বড়দি দীপালির একমাত্র মেয়ে সুচেতা। খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ও সামান্য চোট পেলেই আমরা অস্থির হয়ে যেতাম। তাকে এ ভাবে খুন করা হল!’’

অন্য দিকে, এমন নৃশংস ভাবে খুন করে থাকতে পারেন সমরেশ তা বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁর দাদা কুমারেশ সরকার। বললেন, ‘‘ভাই পাঁঠা কাটা, মুরগি কাটা দেখতে পারত না। বাজারে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকত। সে এই ভাবে খুন করতে পারে, কল্পনাও করতে পারছি না।’’

সহ-প্রতিবেদন: বিতান ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE