Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আতঙ্কে ‘তালাবন্দি’ সন্দেশখালির বাসিন্দারা

আতঙ্ক এমনই যে দিনে নিজেদের ‘বাড়িছাড়া’ দেখাতে চাইছেন হাটগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভাঙিপাড়ার অনেক বাসিন্দা।

সন্দেশখালির ভাঙিপাড়ায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা এমন বিভিন্ন বাড়ির মিল একটাই— দরজায় ঝুলছে ছোট-মেজো-বড় তালা।প্রতীকী ছবি।

সন্দেশখালির ভাঙিপাড়ায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা এমন বিভিন্ন বাড়ির মিল একটাই— দরজায় ঝুলছে ছোট-মেজো-বড় তালা।প্রতীকী ছবি।

প্রদীপ্তকান্তি ঘোষ
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৯ ০৪:০০
Share: Save:

বেড়া-মাটির মিশেলে দেওয়াল আর টালির ছাউনি। কোথাও প্লাস্টারবিহীন দাঁত-মুখ বেরিয়ে থাকা ইটের পাকা বাড়ি। কোথাও আবার বাড়িতে সদ্য রঙের ছোপ।

সন্দেশখালির ভাঙিপাড়ায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা এমন বিভিন্ন বাড়ির মিল একটাই— দরজায় ঝুলছে ছোট-মেজো-বড় তালা। দেখলে মনে হবে, বাড়িতে কেউই নেই। তবে সেই তালা লাগানো দরজা বা বেড়ার গা ঘেঁষে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই কানে আসবে বাসনের টুং-টাং, কথোপকথনের টুকরো।

আতঙ্ক এমনই যে দিনে নিজেদের ‘বাড়িছাড়া’ দেখাতে চাইছেন হাটগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভাঙিপাড়ার অনেক বাসিন্দা। রাতে অবশ্য বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে থাকার সাহসও নেই। মাথা গুঁজতে তাঁরা চলে যাচ্ছেন আশপাশের এলাকায়। আর বুক কেঁপে উঠছে মোটরবাইকের আওয়াজ শুনলেই। বছর ষাটের এক বৃদ্ধের কথায়, ‘‘মারামারি আগেও দেখেছি। কিন্তু এ ভাবে জমায়েত করে বোমা-গুলি চালিয়ে কাউকে খুন করতে দেখেনি। সে দিনও মোটরবাইকেই এখানে এসে গুলি চালিয়ে ভেড়ির মধ্যে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে মেরেছে।’’ কে মেরেছে? অস্পষ্ট জবাব আসে, ‘‘ওরা! বাহিনী।’’ বাড়ির দরজায় তালা দিয়ে ভিতরে থাকছেন, এমন এক মহিলাকে ধরা গেল আচমকা। তাঁর কথায়, ‘‘দরজায় তালা না দিয়ে উপায় কী? বাড়িতে আছি জানতে পারলেই তো নানা বিপদ।’’

শনিবার বিকেলে রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মেছো ভেড়ি ঘেঁষা ভাঙিপাড়া। মৃত্যু হয় দুই বিজেপি এবং এক তৃণমূল কর্মীর। সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, চারিদিকেই ঘাসফুলের পতাকা। মাঝখানে উড়ছে হিন্দু সংহতি নামাঙ্কিত হাতেগোনা গেরুয়া পতাকা।

ঘটনাস্থলের অনতিদূরে বাসিন্দাদের সঙ্গে এ দিন কথা বলতে গিয়েছিলেন বসিরহাট জেলা পুলিশের কয়েক জন অফিসার। হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। মাটির বারান্দায় বসে চোখের জল মুছতে মুছতে কুসুরানি মণ্ডল অফিসারদের বললেন, ‘‘বাবা, কী করে থাকব। শুনছি, আমাদের মুণ্ডু কেটে নিয়ে যাবে! একটা কিছু করো গো!’’ পুলিশ অফিসারদের তরফে বলা হল, ‘‘ওই সব গুজব। আমরা আছি।’’ সে আশ্বাসে খুব আশ্বস্ত হতে দেখা গেল না কুসুরানিকে। কয়েকটি বাড়ি পরে আশারানি মণ্ডলও বললেন, ‘‘স্যার, কিছু করুন। একটা ক্যাম্প (পুলিশ) করুন। না হলে কী করে থাকব।’’

রবিবার ঘটনাস্থলে দলে দলে পুলিশের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছিল ভাঙিপাড়া। কিন্তু রাত থেকে এক ঝটকায় পুলিশের সংখ্যা কমেছে। তাতেই বাড়ছে ভয়। ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ি এলাকায় নিহত তৃণমূল কর্মী কায়ুম মোল্লার বাড়ি। সেই এলাকাও সুনসান।

কায়ুমের বাবা লিয়াকত আলির অভিযোগ, ‘‘বিজেপির ‘ভাষা সন্ত্রাস’ই এলাকায় বিভেদের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। নেতানেত্রীরা যে ভাষা ব্যবহার করছেন, তাতেই উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।’’ আর কায়ুমের জ্যাঠা আকবর আলির দাবি, ‘‘রাতে এসে সব বহিরাগতেরা মিটিং করছে। বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে।’’ বসিরহাট লোকসভা আসনের বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু অবশ্য একবাক্যে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেন। বলেন, ‘‘সমাজবিরোধী নিজেদের গুলিতে মারা গিয়েছে। তাদের এ সব কথা অর্থহীন।’’

এই রাজনীতিতে সরাসরি জড়াতে চাননি রাজবাড়ির দেবব্রত দাস, জয়গোপাল মণ্ডল, রাম মণ্ডলেরা। তাঁদের মুখে একটাই শব্দ—আতঙ্ক! বলছেন, ‘‘আমরা সিঁটিয়ে রয়েছি। শুধু মনে হচ্ছে, আবার হয়তো কেউ খুন হবে। তাই রাতে বাড়িতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।’’

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sandeshkhali Basirhat TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE