সাবির মোল্লা এবং কাঞ্চন গড়াই
ছ’বছর হতে চলল, ওঁরা নিখোঁজ। মাওবাদীদের একদা খাসতালুকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া দুই পুলিশ কনস্টেবল জীবিত নেই ধরে নিয়েই তাঁদের কঙ্কালের হদিস পেতে কোমর বেঁধে নেমেছে রাজ্য পুলিশ।
২০০৯-এর ৩০ জুলাই পশ্চিম মেদিনীপুরে লালগড় থেকে উধাও হয়ে যান রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের দুই কনস্টেবল— প্রথম ব্যাটেলিয়নের সাবির আলি মোল্লা ও ত্রয়োদশ ব্যাটেলিয়নের কাঞ্চন গড়াই। জঙ্গলমহলে তখন মাওবাদী কার্যকলাপ ও খুনোখুনি তুঙ্গে, আর লালগড়ই তাদের মূল ঘাঁটি। গোয়েন্দামহলের একাংশের দাবি, কাঞ্চন-সাবিরকে মাওবাদীরাই তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করে পুঁতে দেয়।
কিন্তু ওঁদের দেহ, দেহাবশেষ বা কঙ্কাল মেলেনি, যাতে সরকারি ভাবে বলা যায় যে, ওঁরা খুনই হয়েছেন। ফলে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও আর্থিক সাহায্যের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ঘিরে জটিলতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে সূত্রের ইঙ্গিত। সমস্যার সুরাহায় কঙ্কাল উদ্ধারে পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনী নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়েছে। মোটা ইনাম দিতেও প্রশাসন তৈরি। মাওবাদী দমনে নিযুক্ত রাজ্য পুলিশের বিশেষ বাহিনী কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স (সিআইএফ) সম্প্রতি কঙ্কালের সন্ধান পেতে লালগড়ে কিছু ‘চর’ নিয়োগ করেছে। কংসাবতীর পাড়ে ও জঙ্গলের কিছু জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে।
এ সবে সাফল্য এখনও না-মিললেও চেষ্টায় ভাটা পড়েনি। কাঞ্চন ও সাবিরের নিকটাত্মীয়দের রক্ত-নখ-চুলের নমুনাও পুলিশ নিয়ে রেখেছে, দেহাবশেষ পেলে ডিএনএ মিলিয়ে দেখার জন্য। বস্তুত বাঁকুড়ার ছাতনার সুয়ারবাকড়া গ্রামের বাসিন্দা কাঞ্চনের বাবা বাসুদেব গড়াই ও মেজো ভাই চিত্তরঞ্জনকে ক’দিন আগে জরুরি ভিত্তিতে মেদিনীপুরে ডেকে পাঠিয়েছিল পুলিশ। বর্ধমানের মেমারির তেলসাড়া গ্রামে সাবিরের মেজদা সামাদ মোল্লারও ডাক পড়ে, যদিও তিনি যেতে পারেননি। পুলিশের কাছে নির্দিষ্ট খবর ছিল, কঙ্কাল দু’টি সে দিন পাওয়া যাবে। পাওয়া অবশ্য যায়নি।
সেই ২০০৯ ও ২০১০ সালে জঙ্গলমহলে বহু মানুষই নিখোঁজ হয়েছেন। অনেকের সন্ধান আজও মেলেনি। পুলিশ-সূত্রের হিসেবে, শুধু লালগড় ও বিনপুর থানা এলাকায় নিখোঁজের সংখ্যা অন্তত ৩০, যাঁদের মধ্যে মহিলা একাধিক। তবে এঁরা সব সাধারণ লোক। সাবির-কাঞ্চন ছাড়া রাজ্যের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় আর কোনও পুলিশ বা সরকারি নিরাপত্তাকর্মী নিরুদ্দেশ হননি। ২০১০-এর অক্টোবরে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে গিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন রাজ্য আইবি’র অফিসার পার্থসারথি বিশ্বাস। বছর ঘোরার আগেই তাঁর দেহ উদ্ধার করে ডিএনএ পরীক্ষায় শনাক্তকরণ হয়ে যায়। কিন্তু সাবির ও কাঞ্চনের দেহ বা দেহাবশেষ না-পাওয়ায় পরিজনেরা সরকারি সাহায্য-ক্ষতিপূরণ সে ভাবে পাচ্ছেন না। কারণ, খাতায়-কলমে দু’জন এখনও ‘মিসিং অন ডিউটি।’
কর্তারা জানাচ্ছেন, দেহ না-মিললেও কোনও পুলিশকর্মী যদি কর্মরত অবস্থায় টানা সাত বছর নিরুদ্দেশ থাকেন, তা হলে তিনি মৃত হিসেবে গণ্য হবেন। নির্দিষ্ট যাবতীয় ক্ষতিপূরণ ও সাহায্য তখনই মিলবে। কিন্তু সে জন্য কাঞ্চন-সাবিরের পরিবারকে ২০১৬-র জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। রাজ্য পুলিশ তার আগেই ব্যাপারটা মেটাতে চাইছে।
তাই নব উদ্যমে কঙ্কাল সন্ধান। প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, মৃত্যু প্রমাণিত হলে প্রতি পরিবার এক লপ্তে ২০ লক্ষ টাকার বেশি পাবেন। কারণ, মাওবাদী হানায় নিহত পুলিশের পরিবার কেন্দ্রীয় ‘সিকিওরিটি রিলেটেড এক্সপেনডিচার’ (এসআরই) স্কিমে বিমার ১০ লক্ষ ও সহায়তা বাবদ ৩ লক্ষ টাকা পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকার দেবে পাঁচ লক্ষ। ‘কর্তব্যরত সরকারি কর্ম়়ীর দুর্ঘটনাবশত মৃত্যু’ বাবদ মিলবে আরও ক’লক্ষ। সঙ্গে প্রভিডেন্ট ফান্ড। উপরন্তু কোনও পরিজন ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে চাকরি চাইলে সরকার তখন সেটাও বিবেচনা করতে পারবে। প্রসঙ্গত, অবিবাহিত সাবির ও কাঞ্চনের ভাইয়েরা ইতিমধ্যে চাকরির আবেদন করেও রেখেছেন।
দুই কনস্টেবল খুন হলেন কী ভাবে? গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি, ২০০৯-এর ৩০ জুলাই জেনারেটরের যন্ত্রাংশ কিনতে ধরমপুর ক্যাম্প থেকে মোটরসাইকেলে লালগড় যওয়ার পথে বড় বৃন্দাবনপুরে মাওবাদীদের খপ্পরে পড়েছিলেন সাবির ও কাঞ্চন। তৎকালীন মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজির নির্দেশে সে দিনই দু’জনের গলা কেটে দেহ পুঁতে দেওয়া হয়।
২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতো গ্রেফতার হন। সাবির-কাঞ্চনকে খুনের কথা তিনিও জানান বলে গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি।
এমতাবস্থায় ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ রাজ্য সরকার মাসে মাসে টাকা জোগাচ্ছে দুই পরিবারকে। ‘‘কিন্তু এটা খুব বেশি দিন চলতে পারে না। ভবিষ্যতে সরকারকে আইনি সমস্যায় পড়তে হতে পারে।’’— মন্তব্য এক পুলিশ-কর্তার। প্রশাসনের বক্তব্য, নিখোঁজ হওয়ার সময়ে দু’জনের যা বেতন ছিল, আপাতত তা-ই দেওয়া হচ্ছে। দু’জনেই ২০০৬-এর গোড়ায় চাকরি পেয়েছিলেন। কাঞ্চনের ভাই চিত্তরঞ্জন জানিয়েছেন, তাঁর বাবার নামে ফি মাসে আসছে প্রায় ১৩ হাজার টাকা। আর সাবিরের দাদা সামাদের দাবি, তাঁর মা পাচ্ছেন মাসে ১৮ হাজার।
সাহায্যের অঙ্কে এ হেন ‘বৈষম্যের’ ব্যাখ্যা অবশ্য পুলিশকর্তাদের কাছে নেই। রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের এডিজি রণবীর কুমার বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখব, পরিবার দু’টি কোন খাতে কত পাচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy