Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
State News

ডেকরেটারের গাফিলতিতেই বিপত্তি প্রধানমন্ত্রীর সভায়, জানাল রাজ্য ফরেন্সিক দফতর

প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চ থেকে মাঠের দিকে মুখ করলে তিনটি আলাদা আলাদা কাঠামোর তলায় দর্শকদের বসার জায়গা। মেদিনীপুরে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ চলাকালীনই ভেঙে পড়ে বাঁ দিকের কাঠামো। আহত হন প্রায় ৯১ জন। 

মেদিনীপুরে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সভার শেষে ভেঙে পড়ে দ্বিতীয় কাঠামোটি।

মেদিনীপুরে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সভার শেষে ভেঙে পড়ে দ্বিতীয় কাঠামোটি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৮ ১৫:০৪
Share: Save:

মেদিনীপুরে প্রধানমন্ত্রীর সভা চলাকালীনই ভেঙে পড়েছিল সভাস্থলের কাঠামো। সেই ঘটনার তদন্তে মঙ্গলবার প্রাথমিক ভাবে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা সংশ্লিষ্ট ডেকরেটারকে দায়ী করেছেন।

তাঁরা প্রাথমিক ভাবে কয়েকটি কারণ খুঁজে বার করেছেন— প্রথমত, লোহার কাঠামো নাট-বল্টু দিয়ে জোড়া দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাঠামোতে নাট-বল্টু পর্যাপ্ত সংখ্যায় ব্যবহার করা হয়নি। দ্বিতায়ত, ছাউনিগুলি ধরে রাখার জন্য যে লোহার পিলার, সেই পিলার আরও গভীরে পুঁতলে এই বিপত্তি এড়ানো যেত।

এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছন এডিজি আইবি সিদ্ধনাথ গুপ্ত, আইজি পশ্চিমাঞ্চল রাজীব মিশ্র এবং জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরাও। সভাস্থল এবং ভেঙে পড়া কাঠামো দেখে

সেই গাফিলতি সামনে আসার পরই রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে সভার উদ্যোক্তা, ঠিকাদার এবং ডেকরেটরের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৮,৩৩৭,৩৩৮ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুনের চেষ্টা, বেপরোয়া কাজ করে মানুষের জীবন বিপন্ন করা এবং তার জন্য মানুষের গুরুতর আঘাতের কারণ হওয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

যদিও এই গাফিলতির দায় মানতে চায়নি রাজ্য বিজেপি। সংগঠনের রাজ্ সম্পাদক রাজু বন্দোপাধ্যায় পাল্টা রাজ্য সরকারকেই দায়ী করেছেন গাফিলতির জন্য। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সভার তিনদিন আগে একটিমাত্র সমন্বয় বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে এসপিজি,জেলা পু্লিশ সুপার, জেলা শাসক এবং উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা উপস্থিত ছিলাম। সেদিনের পর রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আজ যে গাফিলতির অভিযোগ তাঁরা করছেন, সেই দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না।”

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ফরেন্সিক কর্তারা দাবি করেছেন, বর্ষায় মাটি নরম থাকবে এটা ধরে নিয়েই ডেকরেটারের উচিৎ ছিল আরও গভীর করে লোহার পিলার পোঁতা। প্রয়োজনে পিলারের তলায় লোহার প্লেট ব্যবহার করা। রাজ্য ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির ফিজিক্স বিভাগের প্রধান চিত্রাক্ষ সরকার এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘গোড়ার তুলনায় প্যান্ডেলের মাথা অনেক বেশি ভারী হয়ে গিয়েছিল। যে পিলারগুলোর উপর গোটা কাঠামোটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলি মাটিতে পোঁতার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে লোহার নাট ব্যবহার করা হয়নি। এবং যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো সঠিক গভীরতাতেও পোঁতা হয়নি। প্রাথমিক ভাবে এই ত্রুটিই ধরা পড়েছে।’’

আরও পড়ুন: কেউ কথা শোনেননি, ক্ষুব্ধ ডেকরেটর

আরও পড়ুন: সভার মাঝেই ভেঙে পড়ল ছাউনি, বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন মোদী!

অর্থাৎ বিশেষজ্ঞরা মেনে নিয়েছেন গাফিলতি ছিল। কিন্তু সেই গাফিলতি কার? শুধু ডেকরেটরের না সেই দায় আরও অনেকের?

লোহার পিলারের উপর অ্যালুমিনিয়াম এবং লোহার কাঠামো। সেই কাঠামো ঢাকা দেওয়া কাপড় আর ত্রিপলের চাদরে। গোটা কাঠামো একাধিক বার খতিয়ে দেখেছেন এসপিজি থেকে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। তার পরেও এই দুর্ঘটনা!

প্রাথমিক ভাবে পুলিশ থেকে শুরু করে ডেকরেটর সংস্থার অনুমান ছিল— একে বৃষ্টিতে মাটি নরম। তার উপর কিছু অত্যুৎসাহী দর্শক কাঠামোতে উঠে পড়েন। সেই ভার রাখতে পারেনি গোটা কাঠামো।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই তত্ত্ব ধাক্কা খায়। দুপুরে ভেঙে পড়া ছাউনির ঠিক উল্টো দিকে অর্থাৎ মঞ্চের দিক থেকে ডানদিকের ছাউনিও আচমকা ভেঙে পড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ। মেদিনীপুরের ডিএসপি অপারেশনস অতীশ সরকার-সহ কয়েক জন পুলিশ কর্মী তখন ছিলেন সেই ছাউনির তলায়। অল্পবিস্তর চোট লাগে তাঁদের।

দ্বিতীয় কাঠামোটি যখন ভেঙে পড়ে তখন গোটা কলেজ ময়দান ফাঁকা ছিল। কাঠামোর ওপরেও কেউ ওঠেনি। তা হলে কী এমন ঘটল যে নিজে থেকেই সেই কাঠামো ভেঙে পড়ল?

আর সেটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে দিল্লি থেকে আসা দুই কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি এবং রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের। শুধু দ্বিতীয় কাঠামো ভেঙে পড়া নয়, তার পেছনে কলেজ মাঠের পাঁচিলের একটা অংশও সোমবার সন্ধ্যায় ভেঙে পড়ে। এক রাজ্য পুলিশের কর্তা বলেন, “ওই পাঁচিল যদি অনুষ্ঠান চলার সময় ভাঙত, তবে আরও বড় বিপর্যয় হতে পারত।”

সন্ধ্যায় ভেঙে পড়ে এই পাঁচিল। সভা চলাকালীন ভেঙে পড়লে বিপত্তি বাড়তে পারত।

পুলিশ সূ্ত্রে জানা গিয়েছে, উদ্যোক্তাদের তরফে মাঠে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। সাধারণ ভাবে ধরে নেওয়াই হয়, যে প্রধানমন্ত্রীর মতো হাই প্রোফাইল ব্যক্তির অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট দর্শকাসনের থেকে অনেক বেশি মানুষ মাঠে ঢুকবেন। তা ছাড়াও মাঠের বাইরেও অতিরিক্ত আট-দশ হাজার মানুষের ভিড় থাকবে। সোমবার ঠিক তাই হয়েছিল। এই অতিরিক্ত ভিড় প্রত্যাশিতই ছিল।

প্রধানমন্ত্রী মেদিনীপুর আসার আগে দু’দফায় এসপিজি সভাস্থল পরিদর্শন করে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চ তাঁরা নিজেরা দেখেছেন। সরকারি ভাবে প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চ এবং তাঁর আশে পাশের বৃত্তের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাঁদের। এক শীর্ষ পুলিশ কর্তা, যিনি নিজে এসপিজিতে কাজ করেছেন, বলেন, “এই ‘ক্লোজ প্রক্সিমিটি’ শব্দটির ব্যপকতা আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রী বা ভিভিআইপির নিরাপত্তার স্বার্থেই শুধু মূল মঞ্চই নয়, গোটা সভাস্থলের খুঁটিনাটি দেখেন এসপিজি সদস্যরা। তাঁরা স্থানীয় পুলিশ কর্তাদেরও পরামর্শ দেন।’’

যদিও, সরকারি ভাবে সভাস্থলের বাকি অংশের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। পুর্ত দফতর মূল মঞ্চ বা দর্শকাসনের কাঠামো থেকে শুরু করে প্রবেশ-প্রস্থান পথ সব খতিয়ে দেখে ছাড়পত্র দেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদেরও সেই ছাড়পত্র ছিল, এটাও ধরে নেওয়াই যায়।

আর সেই জায়গা থেকেই গাফিলতির অভিযোগটাই জোরদার হচ্ছে।

ডেকরেটারের যদি গাফিলতি থাকে, তা হলে এসপিজি থেকে শুরু করে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তা বা পুর্ত দফতরের কর্তারা কী করছিলেন? তাঁদের নজরে কেন এল না সেই গাফিলতি? মঙ্গলবার তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ওদের মঞ্চ কী করে ভাঙল তা আমরা কী করে বলব। ” সেই সুর ধরেই রাজ্য পুলিশের অন্য এক কর্তার দাবি, “প্রধানমন্ত্রীর সভা যদি সরকারি অনুষ্ঠান হয়, তবে সেখানে রাজ্য প্রশাসনের একটা বড় দায়িত্ব থাকে। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান যদি রাজনৈতিক হয়, তবে সেখানে সেই উদ্যোক্তা রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও ভূমিকা ও দায়িত্ব থাকে গোটা ব্যবস্থায় নজর রাখার।” রাজ্য পুলিশের ওই কর্তা যদিও স্বীকার করেন প্রধানমন্ত্রীর মতো সাংবিধানিক পদে থাকা ভিভিআইপিদের সফর রাজনৈতিক হলেও রাজ্য সরকার দায় এড়াতে পারে না। তবে দায় কার? সেই রিপোর্ট নিতে মঙ্গলবার সকালেই নবান্নে হাজির কেন্দ্রীয় দুই প্রতিনিধি।

ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Prime Minister Narendra Modi Midnapore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE