Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জার্সি আর বুট পরে ভাঁড় ভাঙা পয়সায় ওদের পুজোর শপিং

কিন্তু কে ওদের জার্সি কিনে দেবে? ভাল বুট? কারও বাবা তাঁত বোনেন, কেউ ভ্যান চালান, কেউ বা খেতমজুর। প্র্যাক্টিসে সঙ্গী শুধু জেদ আর একটু-একটু মনখারাপ। বন্ধুদের এত কিছু হতে পারে আর ওদের একটু-আধটুও হবে না? 

প্র্যাক্টিসে সোনালী দেবনাথ। নিজস্ব চিত্র

প্র্যাক্টিসে সোনালী দেবনাথ। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:০০
Share: Save:

পাঁচ আর দশ টাকার কয়েনগুলোয় কালচে-সবজে ছোপ। একটা-একটা করে গুনে একগাদা খুচরো কাউন্টারে রাখতেই দোকানদার খ্যাঁক করে উঠলেন— “এ বাবা! কোথায় রেখেছিলি এগুলো? মাটির নীচে ঘড়ায়?” কাঁচুমাচু মুখে নবদ্বীপের ঝলমলে দোকানে দাঁড়িয়ে পায়েল, তনুশ্রী, নন্দিনী, সোমারা। সত্যিই তো! কয়েনগুলোর আর দোষ কি? এক বছরেরও বেশি ধরে মাটির ভাঁড়ে জমানো ছিল!

মহালয়া চলে এল। বন্ধুরা সব বাছাই করে কিনেছে লং কুর্তি, ড্রেস, র‌্যাপার। আহা-বাহা শাড়ি তো আছেই। সঙ্গে ম্যাচিং চটি, হাই হিল। ওরাও শপিং করতেই বেরিয়েছে— স্টাড দেওয়া বুট, হাঁটু পর্যন্ত আঁটো মোজা, রঙিন জার্সি... কাশ নয়, ওরা ঘাস বেশি ভালবাসে। মাঠে দাপিয়ে বেড়ায় বল পায়ে। মাঠ পেরিয়ে বল উড়ে গেলে তবেই তো কাশবন ডিঙিয়ে কুড়োতে যাওয়া!

কিন্তু কে ওদের জার্সি কিনে দেবে? ভাল বুট? কারও বাবা তাঁত বোনেন, কেউ ভ্যান চালান, কেউ বা খেতমজুর। প্র্যাক্টিসে সঙ্গী শুধু জেদ আর একটু-একটু মনখারাপ। বন্ধুদের এত কিছু হতে পারে আর ওদের একটু-আধটুও হবে না?

নবদ্বীপ থেকে গঙ্গা পেরোলে নদিয়ারই স্বরূপগঞ্জ এলাকা। সকলেই স্বরূপগঞ্জ পানশীলা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। পায়েল দাস আর সোমা শীল অষ্টম শ্রেণি, তনুশ্রী দেবনাথ নবম। সোনালী দেবনাথ একাদশ শ্রেণি। সবচেয়ে ছোট নন্দিনী দেবনাথ— সপ্তম। কিন্তু স্বপ্ন সকলেরই এক। ফুটবল খেলে নাম করতে হবে, জীবনে দাঁড়াতে হবে।

বাড়িতে তাঁতের খটাখট শুনে বড় হয়েছে মাজদিয়া বেলডাঙার পায়েল আর মহেশগঞ্জ বিপ্রনগরের তনুশ্রী। পাওয়ারলুমের চাপে এখন সে তাঁতের নাভিশ্বাস উঠছে। মাঠপাড়ার নন্দিনীর বাবা মেলায় কাঁসার বাসন বিক্রি করেন। নবদ্বীপ-ব্যান্ডেল ট্রেনে এটা-ওটা ফিরি করেন মাজদিয়ার সোনালীর বাবা। আর স্বরূপগঞ্জের সোমার বাবা খেতমজুর।

গাঁয়ের বেড়া টপকে মেয়েগুলো এখন আসছে নবদ্বীপে অ্যাথলেটিক ক্লাবের মাঠে। ফি শনি-রবি। আগে যা ছিল গাঁয়ের মাঠে খেয়ালখুশির খেলা, তাতে লাগছে ব্যাকরণের পালিশ। স্বপ্নে বুঁদ— এর পরে কলকাতায় খেলতে যাবে।

কিন্তু ঠিকঠাক জামা-জুতো না পেলে কি বড় মাঠে নামা যায়? সকলে হাতখরচ বাঁচিয়ে তাই পাঁচ-দশ টাকা ভাঁড়ে ফেলতে শুরু করেছিল। পুজোর মুখে ভাঁড় ভেঙে কারও বেরিয়েছে ৫৬০, কারও ৪৮০। সাধারণ ফুলসেট জার্সি-জুতো কিনতেও অন্তত সাড়ে ছ’শো টাকা লাগে। তনুশ্রী বলে, ‘‘রোজ তো আর টাকা ফেলতে পারিনি। হাতে কিছু বাঁচলে তবেই না!’’ বাকিটুকু জুগিয়েছেন ক্লাবের দাদারা।

আর, জমজমাট পোড়ামাতলা বাজারে র‌্যাক থেকে জার্সি নামাতে-নামাতে দোকানদার বিমল ভৌমিক গজগজ করছেন— ‘‘পুজোর দিনে সব ছেড়ে এলি খেলুড়ে হতে? নে দেখ, বেছেবুছে নে...।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Football girl Shopping Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE