Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জালিয়াতির দায়ে পুলিশ জালে মমতা-ঘনিষ্ঠ

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী হয়ে তিনি যে দিন বাংলাদেশের বিমানে উঠেছিলেন, সে দিনই তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছিল ‘লুক আউট’ নোটিস। শনিবার ঢাকা থেকে কলকাতা ফেরার বিমানে ওঠার আগে তিনি ট্যুইট করেছিলেন, ‘বিদায় বাংলাদেশ, দেখা হবে আবার’। কিন্তু দিল্লিতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কাছ থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে ১৮ কোটি ঋণ নেওয়ার অভিযোগে কলকাতায় নামার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শিবাজি পাঁজাকে আটক করেন বিমানবন্দরের অভিবাসন শাখার অফিসারেরা।

ব্যারাকপুর আদালতের পথে শিবাজি পাঁজা। রবিবার।  নিজস্ব চিত্র

ব্যারাকপুর আদালতের পথে শিবাজি পাঁজা। রবিবার। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী হয়ে তিনি যে দিন বাংলাদেশের বিমানে উঠেছিলেন, সে দিনই তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছিল ‘লুক আউট’ নোটিস। শনিবার ঢাকা থেকে কলকাতা ফেরার বিমানে ওঠার আগে তিনি ট্যুইট করেছিলেন, ‘বিদায় বাংলাদেশ, দেখা হবে আবার’। কিন্তু দিল্লিতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কাছ থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে ১৮ কোটি ঋণ নেওয়ার অভিযোগে কলকাতায় নামার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শিবাজি পাঁজাকে আটক করেন বিমানবন্দরের অভিবাসন শাখার অফিসারেরা। তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নিয়ম মতো রবিবার শিবাজি পাঁজাকে ব্যারাকপুর আদালতে পেশ করা হয়। কিন্তু প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে দিল্লি পুলিশ সময় মতো কলকাতায় পৌঁছতে না পারায় তাঁকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয় আদালত। বিচারকের নির্দেশ, ১০ মার্চের মধ্যে দিল্লির আদালতে হাজিরা দিতে হবে শিবাজিকে। তদন্তকারীদের সব রকম ভাবে সাহায্যও করতে হবে তাঁকে।

মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শিবাজি পাঁজার গ্রেফতারের খবরে শাসক দল ও রাজ্য প্রশাসনের অন্দরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। নতুন সরকারের আমলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থেকে কী ভাবে তাঁর প্রায় উল্কার গতিতে উত্থান হল, তা নিয়েও শুরু হয়েছে চর্চা। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে ঢাকা-সফর করে এসেছেন সদ্য। তবু গ্রেফতারের খবরের পরে স্পষ্টতই বিব্রত মমতা এখন শিবাজি পাঁজাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে আগ্রহী! এ দিন পটনা যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে শিবাজির গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে স্পষ্টতই ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কেন? আমি কি ব্যবসা করি? কোনও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা থাকতেই পারে। তা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীর ব্যাপার। আমার সঙ্গে কোনও ভাবে জড়িত নয়।” কিন্তু ওই ব্যবসায়ী তো আপনার ঘনিষ্ঠ! বাংলাদেশে আপনার সফরসঙ্গী ছিলেন! আপনার প্রতিনিধি দলের সদস্য! এ বার আরও উত্তেজিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এটা কোনও সরকারি প্রতিনিধি দল ছিল না। আপনি উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করছেন!”

মমতা-ঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ীকে কেন গ্রেফতার করল পুলিশ? দিল্লি পুলিশের ডিসি (আর্থিক অপরাধ দমন শাখা) বি কে সিংহ এ দিন জানান, গত বছরের ২১ জুলাই কালকাজি দক্ষিণ থানায় শিবাজি পাঁজার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফিনান্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (আইএফসিআই)-র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জীবন সিংহ। অভিযোগ ছিল, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আইএফসিআই থেকে ১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন শিবাজি। ঋণ নেওয়ার সময় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর সংস্থা আর-পি গ্রুপ অব কোম্পানিজ ‘চিরাগ’ কম্পিউটার তৈরি করে। তাঁদের কাছে বড় মাপের কম্পিউটার সরবরাহের বরাত রয়েছে। সেই কারণেই ঋণ দরকার। দাবির সপক্ষে সব নথিও জমা দেন শিবাজি।

কিন্তু ঠিক সময়ে ঋণ শোধ না করার অভিযোগে শিবাজির বিরুদ্ধে তদন্তে নামে দিল্লি পুলিশের আর্থিক অপরাধ দমন শাখা। দেখা যায়, কম্পিউটার সরবরাহের বরাত আছে দাবি করে যে সব নথি শিবাজি জমা দিয়েছিলেন, তার সবই জাল! ওই ধরনের কোনও বরাত ছিল না শিবাজি বা তাঁর সংস্থার কাছে! এর পরেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং নথি জালের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। দিল্লি পুলিশের দাবি, শিবাজির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। প্রায়শই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা গেলেও নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছিলেন এই ব্যবসায়ী। দিল্লি পুলিশের ডিসি বলেন, “ঋণ নেওয়ার সময় যে সব ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও শিবাজি পাঁজার খোঁজ মেলেনি। তাই তাঁর নামে লুক আউট নোটিস জারি করা হয়। কারও নামে লুক আউট নোটিস থাকলে, তিনি বিদেশে গেলে বা বিদেশ থেকে ফেরার সময় বিমানবন্দরেই ধরা পড়েন। শিবাজির ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।”

কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর, শনিবার রাত ৯টা ৫২ মিনিটে ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে নামেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীরা। তাঁরা বিমান থেকে নেমে অভিবাসন দফতরের দিকে এগিয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রীকে যাতে অভিবাসন দফতরে দাঁড়াতে না হয়, তাই তাঁকে নিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা বেরিয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রীর অভিবাসন সংক্রান্ত কাজও ততক্ষণে হয়ে গিয়েছে। দলের বাকিরা অভিবাসন কাউন্টারের সামনে পাসপোর্ট পরীক্ষা করাতে থাকেন। এই সময়ে শিবাজির পাসপোর্ট দেখে তাঁকে একপাশে সরে দাঁড়াতে বলেন এক অফিসার। একটু পরে তাঁকে অ্যারাইভাল হলে অভিবাসন দফতরের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম তখন সবে অভিবাসন দফতর ছেড়ে শুল্ক দফতরের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি খবর পান, শিবাজিকে আটকে দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, ফিরহাদ তখন খবর পাঠান মুখ্যমন্ত্রীকে।

ততক্ষণে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে চলে গিয়েছেন বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম। খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে রওনা করিয়ে দিয়ে তিনি ফিরে যান টার্মিনালের ভিতরে। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, শুল্ক দফতরের এক পাশে ফিরহাদ ও শামিমকে অনেক ক্ষণ একান্তে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায়। মাঝে ফিরহাদ নিজে গিয়ে কথাও বলেন অভিবাসন অফিসারদের সঙ্গে। জানতে চান, কেন আটকে রাখা হল শিবাজিকে। রাত সাড়ে এগারোটার পরে তিনি ও শামিম বেরিয়ে যান। তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দর থানার অফিসারেরা শিবাজিকে নিয়ে বেরিয়ে যান। ততক্ষণে সরকারি ভাবে শিবাজিকে রাজ্য পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন অভিবাসন দফতরের অফিসারেরা। পুলিশ সূত্রের খবর, রাতেই শিবাজিকে নিয়ে যাওয়া হয় বিধাননগরের সরকারি হাসপাতালে। রবিবার সকাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

এ দিন সকালেই ব্যারাকপুর আদালতে নিয়ে আসা হয় শিবাজিকে। পুলিশের একটি টাটা সুমো গাড়ি চাপিয়ে আকাশি নীল রংয়ের শার্ট পরা শিবাজিকে সোজা কোর্ট লকআপে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুর আড়াইটে নাগাদ শুনানি শুরু হলে সরকারি আইনজীবী মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিস রয়েছে। রিমান্ড নোটিস দিল্লি থেকে না আসা পর্যন্ত ধৃতকে জেল হেফাজতে রাখা হোক। শিবাজিকে কী কী ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে, তার তথ্য তুলে দেওয়া হয় আদালতকে। এর বিরোধিতা করে শিবাজির আইনজীবী রাজদীপ মজুমদার, অনিন্দ্য রাউথ-সহ ছ’জন আইনজীবী পাল্টা অভিযোগ করেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া লুক আউট নোটিস জারি হয়েছে। তাঁদের মক্কেলকে গ্রেফতার করা হলেও অভিযোগ সংক্রান্ত কোন নথি বা প্রতিলিপি আদালতে জমা দেয়নি পুলিশ। এমনকী কেন গ্রেফতার করা হল, তার কোনও কারণও আদালতে জানানো হল না। দু’পক্ষের সওয়াল শেষে দিল্লি পুলিশের জন্য প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করে ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট রাজর্ষি মুখোপাধ্যায় দু’জন জামিনদার এবং ব্যক্তিগত ৫০ হাজার টাকা বন্ডে শিবাজির জামিন মঞ্জুর করেন।

কেন সময়ে নথি পেশ হল না আদালতে?

দিল্লি পুলিশের ডিসি রাতে জানান, “শিবাজি পাঁজার বিরুদ্ধে সব রকম তথ্যপ্রমাণ নিয়ে ইন্সপেক্টর সন্তোষ ঝা-এর নেতৃত্বে একটি দল রাতেই কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁরা আইনি প্রক্রিয়া মেনে শিবাজিকে দিল্লিতে নিয়ে আসবেন। তার পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” শিবাজির বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, নথি জাল, নথি জাল করে প্রতারণা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৫, ৪৬৮ ও ৪৭১, ১২০বি ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি বাদে বাকি সবগুলিই জামিনঅযোগ্য অপরাধ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১ ধারায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ওই ধারায় কাউকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করা যায়। এই ঘটনায় আর কেউ জড়িত কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গ্রেফতারি প্রসঙ্গে রাতে ফোন করা হলে শিবাজি বলেন, “এটা বিচারাধীন বিষয়। এ নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।”

দিল্লি পুলিশ সূত্রের খবর, এই মামলাটি ছাড়াও শিবাজি পাঁজা তথা আর-পি গ্রুপ অফ কোম্পানিজের বিরুদ্ধে দিল্লির বিভিন্ন থানায় আরও অভিযোগ দায়ের হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তার প্রায় সবগুলিই সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ভুয়ো নথি দেখিয়ে ঋণ নেওয়া ও তা ঠিক সময়ে শোধ না করার অভিযোগ। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর সই করা চেকও বাউন্স করেছে বলে অভিযোগ জমা পড়েছে। এই মামলাগুলিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একটি মামলায় কিছুদিন আগে শিবাজি আগাম জামিন নিয়েছিলেন বলেও জানতে পেরেছেন তদন্তকারী অফিসারেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE