Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বিপুলের হাবেভাবে ভয় দেখেছিলেন বোন

কোনও বিপদের আঁচ হয়তো আগাম পেয়েছিলেন বিপুল রায়চৌধুরী। এমনই মনে করছেন বাঁকুড়ার এই নিহত ঠিকাদারের আত্মীয়-পরিজনেরা। তদন্তকারীদের মনেও এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিপুল রায়চৌধুরী

বিপুল রায়চৌধুরী

সুব্রত সীট ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্গাপুর ও বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৫ ০৩:১৭
Share: Save:

কোনও বিপদের আঁচ হয়তো আগাম পেয়েছিলেন বিপুল রায়চৌধুরী। এমনই মনে করছেন বাঁকুড়ার এই নিহত ঠিকাদারের আত্মীয়-পরিজনেরা। তদন্তকারীদের মনেও এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

১৪ জুলাই সকালে কল্যাণী থেকে রওনা হওয়ার আগে বিপুলবাবুর ভিতরে চাপা উদ্বেগ বা উত্তেজনা ছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর মামাতো বোন নন্দিতা সরকার। কেন কল্যাণী থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার পথে বোনকে ঘনঘন ফোন করতে বলেছিলেন বিপুলবাবু, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও। তদন্তকারীদের একাংশের মতে, কোনও বিপদ ঘটে গেলে পরিবার যাতে তাঁর শেষ ‘লোকেশন’ জানতে পারে, তাই বারবার বোনের সঙ্গে কথা বলছিলেন বিপুল। পুলিশও বিপুলবাবুর কল ডিটেলস রেকর্ড ঘেঁটে দেখেছে, ১৪ তারিখ সকালে বারবার তাঁর কথা হয়েছে নন্দিতাদেবীর সঙ্গে। তবে, তা সবই সামান্য সময়ের জন্য।

শেষবার বোনের সঙ্গে কথা হয়, যখন তিনি দুর্গাপুরে। আর দুর্গাপুর থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান বাঁকুড়ার প্রতাপবাগানের বাসিন্দা। ১৫ তারিখ বিপুলবাবুর আধপোড়া দেহ উদ্ধার করে ধানবাদের রাজগঞ্জ থানার পুলিশ। নন্দিতাদেবী জানান, ১৩ জুলাই রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বিপুলবাবুর মোবাইলে একটি ফোন আসে। একাকী প্রায় এক ঘণ্টা দোতলায় গিয়ে ফোনে কথা বলেন বিপুলবাবু। নন্দিতাদেবী বলেন, “ও নেমে এসে বলে, এখুনই বাঁকুড়া ফিরতে হবে। অত রাতে আমি ওকে ছাড়তে রাজি হইনি। পর দিন সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে বিপুল। কিন্তু অসুস্থতার জন্য বের হতে আরও ঘণ্টা তিনেক লেগে যায়।’’ নন্দিতাদেবীর সংযোজন, “১২ তারিখ রাতে আমাকে বিপুল জিজ্ঞেস করেছিল, ও যদি কোনও খারাপ কাজ করে তাহলে ওকে আমি ক্ষমা করব কি না। কেন এমন প্রশ্ন করল, এখনও বুঝতে পারছি না। তবে ওর হাবেভাবে কেমন যেন একটা ভয় ছিল। তখনও ভাবিনি, ওর এমন পরিণতি হবে!’’

বিপুল-খুনের প্রকৃত কারণ নিয়ে অবশ্য এখনও ধোঁয়াশায় তদন্তকারীরা। বাঁকুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সবরি রাজকুমার কে বলেন, “ঠিক কী কারণে ওই ঠিকাদারকে খুন করা হল, তা পরিষ্কার নয়। তদন্ত চলছে।’’

তাঁকে খুনের ঘটনায় পুলিশ দুর্গাপুর থেকে শ্রাবণী মণ্ডল ওরফে ডলি মল্লিক, সরাফত আলি ওরফে সুদর্শন প্রসাদ-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে। বিপুলবাবুর ঘনিষ্ঠ সরাফতই তাঁকে খুনের মূল চক্রী বলে পুলিশের দাবি। শ্রাবণী ও সরাফত দুর্গাপুরে একটি স্পা-এর সঙ্গে যুক্ত। ওই স্পা-এর আড়ালে দু’জনে দেহব্যবসা চালাত বলেও পুলিশ জানতে পেরেছে। জেরায় পুলিশ এ-ও জেনেছে, সরাফতের কাছে কয়েক মাস আগে টাকা ধার নিয়েছিলেন বিপুলবাবু। তার জন্য নিজের গাড়িও কিছুদিনের জন্য সরাফতের কাছে জমা রেখেছিলেন তিনি। বেশির ভাগটাই শোধ করে দিলেও হাজার চল্লিশেক টাকা শোধ করতে বাকি ছিল। কিন্তু কেন টাকা নিয়েছিলেন বিপুলবাবু, তা স্পষ্ট নয়। অন্ধকারে পরিবারও। নন্দিতাদেবীর স্বামী সোমনাথ সরকার বলেন, “কল্যাণীতে ফ্ল্যাট কেনার জন্য হোমলোনের চেষ্টা করছিল বিপুল। কিন্তু ও কারও কাছে টাকা ধার করেছিল বলে জানা নেই। তা ছাড়া, মাত্র ৪০ হাজার টাকার জন্য বিপুলকে খুন করা হবে, এটাও মানতে পারছি না।’’

পুলিশ আরও জেনেছে, দুর্গাপুরের নব ওয়াড়িয়ায় জাতীয় সড়কের ধারে বছর খানেক আগে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ওই বাড়ি ভাড়া নেয় শ্রাবণী ওরফে ডলি এবং জনৈক দীপ মল্লিক। বাড়ির মালিক পুলিশকে জানিয়েছেন, ভাড়া নেওয়ার সময় দীপ মল্লিক আধার কার্ডের ফোটোকপি জমা দিয়েছিল। সেটি পরীক্ষার জন্য পুলিশ নিয়ে গিয়েছে। তবে ডলি ওরফে শ্রাবণীর কোনও প্রমাণপত্র জমা দেওয়া হয়নি। সরাফতই নাম ভাঁড়িয়ে দীপ সেজেছিল কিনা, তা জানার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই বাড়িতে কোনও অসামাজিক কাজ তাঁরা দেখেননি। ফলে, খুনের অভিযোগে ডলি ধরা পড়ায় অনেকেই অবাক হয়েছেন।

পুলিশ আরও জেনেছে, ডলি ওরফে শ্রাবণীর আসল বাড়ি দুর্গাপুরের ডিটিপিএস এলাকার সুকান্তপল্লিতে। তাঁর বাবা কলমিস্ত্রি। শ্রাবণীর ডাকনাম ‘টুম্পা’। ২০০৭-এ স্থানীয় বাসিন্দা, পেশায় গাড়ি চালকের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে হয় শ্রাবণীর। শ্বশুরবাড়িতে নাম হয় ‘ডলি’। বিয়ে অবশ্য টেকেনি। স্বামীর সঙ্গে অশান্তি লেগেই থাকত। এরই মাঝে তাদের মেয়ে হয়। ইতিমধ্যে মাধ্যমিক পাশ করে পুরসভা থেকে বিউটিশিয়ানের কোর্স করে শ্রাবণী যোগ দেয় সিটি সেন্টারের একটি বিউটি পার্লারে। কিন্তু, কাজের ধরন পছন্দ না হওয়ায় স্বামীর সঙ্গে অশান্তি বাধে। আত্মহত্যার চেষ্টাও করে শ্রাবণী। শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বরে ডিভোর্স হয়ে যায়।

প্রাক্তন স্বামীর দাবি, বিউটি পার্লারে কাজের নাম করে অসৎ উপায়ে রোজগারের পথ নিয়েছিল শ্রাবণী। তিনি হাতেনাতে ধরেও ফেলেছেন কয়েক বার। আর শ্রাবণীর বাবা বলেন, ‘‘মেয়ের উচ্চাশাই কাল হল। আমাদের অমতে বিয়ে করায় ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু, পরের দিকে যে-ভাবে আজেবাজে কাজে ও জড়িয়ে গেল, তা বলার মতো নয়!’’

দুর্গাপুর পুরসভা সূত্রে আবার জানা গিয়েছে, সরাফত ওরফে সুদর্শন প্রসাদের আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিন সামগ্রীর দোকানের ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে বাঁকুড়ার পাহাড়পুরের তাপস দাসের নামে। ট্রেড লাইসেন্স পেতে যে নথি জমা করা হয়েছে, তা অনুযায়ী, তাপসের হয়ে ব্যবসা করার অনুমতি নিয়েছে সুদর্শন। দোকানের মাসিক ভাড়া ১৭ হাজার টাকা! এ বছর ৩০ জানুয়ারি গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে এই চুক্তি হয়। ২০ এপ্রিল লাইসেন্স চেয়ে পুরসভায় আবেদন জমা পড়ে। তাপসের নামে লাইসেন্স তৈরিও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তা নিতে কেউ আর পুরসভায় আসেনি। বাড়িভাড়াও বকেয়া পড়ে কয়েক মাস।

অন্য দিকে, বেঙ্গল অম্বুজায় এমএস ১৪/১৬ নম্বর বাড়ির এক তলায় বিউটি পার্লার ও স্পা খোলার জন্য এ বছরই ২৫ জুন পুরসভায় ট্রেড লাইসেন্স চেয়ে আবেদন জমা পড়ে সেই তাপস দাসেরই নামে। বর্তমানে পুরসভা বিউটি পার্লারের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখায়, তা আর মেলেনি। আবেদনের সঙ্গে তাপসের ভোটার কার্ড জমা দেওয়া হয়েছে। আবেদন পত্রে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বর এখন বন্ধ। তালাবন্ধ থাকায় বাড়ির মালিক শিবনাথ দে-র সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এই বাড়িতেই ১৪ তারিখ বিপুলবাবুকে নিয়ে গিয়ে প্রথমে মদ্যপান করিয়ে পরে খুন করা হয় বলে জেরার মুখে ধৃতেরা পুলিশকে জানিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE