Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জলমগ্ন ছিটের ভিটেয় কিলবিল করছে সাপ

নেট সিমেন্টের বাঁধানো উঠোনের উপরে সার বাঁধা টিনের একচালা ঘর। পরবাসী মানুষের স্বদেশের ঠিকানা— ছিটের হলদিবাড়ি ক্যাম্প।

জল ঢুকেছে ছিটের ক্যাম্পে। — নিজস্ব চিত্র

জল ঢুকেছে ছিটের ক্যাম্পে। — নিজস্ব চিত্র

রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নমিতেশ ঘোষ
হলদিবাড়ি ও দিনহাটা শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০৪:০৮
Share: Save:

নেট সিমেন্টের বাঁধানো উঠোনের উপরে সার বাঁধা টিনের একচালা ঘর। পরবাসী মানুষের স্বদেশের ঠিকানা— ছিটের হলদিবাড়ি ক্যাম্প।

দেশের মাটিতে ফিরে, ক্যাম্পের এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘স্বপ্নভঙ্গ হল জানেন, বছর ঘুরে গেল অথচ আমাদের দুর্দিন ঘুচল না!’’

পরবাসে আর থাকবেন না বলে, অনেক লড়াইয়ের পরে বাংলাদেশের ছিট থেকে ক্যাম্পে এসে উঠেছিলেন পরিবার নিয়ে। কিন্তু ভিটে-জমি ছেড়ে কী পেয়েছেন? বলছেন, ‘‘স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ছেড়ে দিন, একটা সরকারি আমলারও দেখা পাইনা যাঁকে বলব, ঢের হয়েছে পুরনো ছিটেই ফিরতে চাই!’’

শ্রাবণে অনর্গল বৃষ্টিতে হাঁটু ডোবা জলের তাঁদের এখন দিনযাপন। দুপুরভর রোদে তেতে থাকা টিনের ঘরে রাতে আর টেঁকা যায় না। কিন্তু বাইরে তো এক হাঁটু জল।

বৃষ্টির সকালে বারান্দার এক কোণে রাখা ভেজা খড়ের মধ্যে রান্নার জন্য জ্বালানির খোঁজ করছিলেন লক্ষ্মী বর্মন। আচমকা ফোঁস করে ওঠে গোখরো সাপ। লক্ষ্মী বলছেন, ‘‘বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছি।’’ তিনি একা নন, ছিটের ক্যাম্পে এ অভিজ্ঞতা অধিকাংশেরই। তাঁদের কেউ বরাত জোরে বেঁচেছেন, কেউ বা সাপ-বিছে-পোকামাকড়ের কামড়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। লক্ষ্মীর মতো সকলেই বলছেন, ‘‘চারদিকে জল। যখন তখন ঘরে ঢুকে পড়ছে সাপ। কী অবস্থার মধ্যে যে আছি আমরাই জানি!” সাপের আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে হলদিবাড়ির কৃষি ফার্ম সংলগ্ন ক্যাম্পের প্রায় সব বাসিন্দাকেই।

সন্ধ্যে নামলেই অন্ধকার গ্রাম। বুধবার রাতে সেই অন্ধকার হাতড়েই বাজার ফেরত মশালডাঙার সামসুল হক, সব্জির ব্যাগ নামিয়েই দেখেন রান্নাঘরে কিলবিল করছে সাপ। বলছেন, ‘‘টর্চের আলো ফেলতেই দেখি একটি সাদা-হলুদ রঙের ডোরাকাটা সাপ। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পর বের করেছি তাকে!’’

শঙ্খিনী, ভেমটিয়া, দাঁড়াশ, গোখরোর ভয়ে তটস্থ হয়ে আছেন কোচবিহারের মধ্য-মশালডাঙা, পোয়াতুরকুঠি-সহ ছিটের মানুষ। রাতের ঘুম চলে গিয়েছে। আতঙ্ক, দুশ্চিন্তার পাশাপাশি হতাশা আর ক্ষোভ বাড়ছে বিভিন্ন ক্যাম্পে। অথচ ছবিটা একেবারে উল্টো বাংলাদেশের ছিটে। বছর খানেক আগেও আঁধার নিঝুম সেই ছিটে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ৪১ হাজার ছিটবাসীর জন্য তৈরি হয়েছে ৬৭টা প্রাথমিক স্কুল, ১৪টা হাইস্কুল একটা কলেজ। প্রতি ৬ জনের জন্য গভীর নলকূপ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। সেই ছিট থেকে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের রেল ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন ৭৮ জন।

আর এখানে? ছিটমহলের ‘সিটিজেন রাইটস ফোরামের’ পক্ষে দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘এখানে সবই হয়েছে খাতায় কলমে, বাস্তবে নয়। জমি জোগাড়ের কাজই অসম্পূর্ণ। এমনকী ক্যাম্পের এই অস্বাস্থ্যকর আবাসও হয়েছে টেন্ডার ছাড়াই।’’ কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন অবশ্য ভরসা দিচ্ছেন, ‘‘৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। বর্ষা মিটলেই কাজ শুরু হবে।’’

এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ছিটের বাসিন্দা এরশাদ আলি বলছেন, ‘‘সবই ফাঁকা আশ্বাস, এ ছিটে আর মন টিঁকছে না ভাই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rain submerge place snake
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE