Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শেষ বার্তাও প্রকাশ পায় সেই সোশ্যাল মিডিয়ায়!

আবার অস্বাভাবিক মৃত্যু। আবার এক কিশোরী। আবারও সোশ্যাল মিডিয়া। কোনওটাই নতুন নয় শহরবাসীর কাছে। অনেকেই বলবেন, চারপাশের মানুষের নজর কাড়তেই ঘটছে এমন।

সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৮ ০৩:১৯
Share: Save:

সুইসাইড নোটের ধরনটাই বদলে গিয়েছে!

আবার অস্বাভাবিক মৃত্যু। আবার এক কিশোরী। আবারও সোশ্যাল মিডিয়া। কোনওটাই নতুন নয় শহরবাসীর কাছে। অনেকেই বলবেন, চারপাশের মানুষের নজর কাড়তেই ঘটছে এমন। বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য তা মানেন না। বরং তাঁরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়া এসে বদলে দিয়েছে সুইসাইড নোট লেখার ধরনটা।

সোনারপুরে দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর দেহ উদ্ধারের পরে অভিযোগ উঠেছে, ফেসবুক লাইভে সে জানিয়েছিল তার ‘আত্মহননের ভাবনার’ কথা। শুধু সে-ই নয়, এমন ঘটনা বারবার ঘটছে শহরে। কখনও মৃত্যুর আগে ফেসবুকে ‘স্টেটাস আপডেট’, কখনও বা ‘কভার ফোটো’ বদল। হোয়াটসঅ্যাপের স্টেটাস কিংবা ইনস্টাগ্রামের ছবিতেও কখনও পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মনের অবস্থার কথা। এই প্রবণতা দেখে অবাক হচ্ছেন অনেকেই। হচ্ছে নানা আলোচনাও। তবে মৃত্যুর আগে হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে জানান দেওয়ার প্রবণতা দেখে মোটেও অবাক নন মনোরোগের চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব। তাঁর বক্তব্য, মৃত্যুর আগে ইঙ্গিত দেওয়া বহু প্রচলিত ঘটনা। এক-এক সময়ে তা এক-এক ভাবে হয়ে এসেছে। কত মানুষের মৃত্যুর আগে লেখা চিঠি এখন শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যের তালিকার অংশ। এখনকার তরুণ সমাজের কাছে সেই ইঙ্গিত দেওয়ার মাধ্যমটাই হল সোশ্যাল মিডিয়া।

কবি শ্রীজাতও একই ভাবে মনে করেন, ধীরে ধীরে বদলাতে থাকা সমাজে এটাও একটা বদল। তিনি বলছিলেন, ‘‘অনেক সময়েই কোনও এক জনের মৃত্যুর পরে চিঠি উদ্ধার হয়। আগে চিঠি লেখার প্রবণতা সব ক্ষেত্রেই বেশি ছিল, ফলে মৃত্যুর কারণ এবং ইঙ্গিতও চিঠির মাধ্যমেই বেশি আসত।’’ শ্রীজাতের বক্তব্য, মৃত্যুর সময়ে সকলেই সবচেয়ে পরিচিত যে মাধ্যম, সেইটাই তো বেছে নেয় আপনজনেদের কাছে নিজের বার্তাটুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ও মনে করেন, এ প্রজন্ম চিঠি লেখার সঙ্গে বিশেষ পরিচিত নয়। তারা যাতে স্বচ্ছন্দ, তা-ই ব্যবহার করছে মনের কথা বলতে। তাঁর বক্তব্য, এখন নিজের মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তাও সহজ নয়। বাড়িতে বাবা-মা, ভাই-বোন— সকলে যে সকলের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেন, এমন একেবারেই নয়। ফলে কিশোর-তরুণদের মধ্যে একাকিত্বের সমস্যা বাড়ছে। একাকিত্ব যত গ্রাস করছে, ততই যেন সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে নির্ভরতা বাড়ছে। নিজের কথা বলারও যে একটা জায়গা লাগে।

ফেসবুক-নির্ভর এই প্রজন্মকে আগের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো বিশেষ বুঝবেন না বলে মত এই বিশেষজ্ঞদের। তবে যুগে যুগে অন্যের কানে-মনে নিজের কথা পৌঁছে দেওয়ার যে চল ছিল, তার মাধ্যম এখন এটাই। তা ছাড়া, সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু নিয়েই রাখ-ঢাক তুলনায় কমেছে। প্রেম হোক বা মন খারাপ— একটু হলেও লুকোনোর প্রবণতা কম আগের থেকে। আগে অনেক কিছুই লুকিয়ে করার ভাবনা আসত। সে রকমই মৃত্যুর পরে সুইসাইড নোটটাও খুঁজে নিতে হত অধিকাংশ ক্ষেত্রে। মনোরোগ চিকিৎসক শ্রীমন্তী চৌধুরী বলছিলেন, এখন সেই জড়তা কেটেছে। জড়তা কেটে যাওয়ার যেমন ভাল দিক থাকে, তেমন উল্টো দিকটাও সামলাতে হয় সমাজকেই। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের খেয়াল রাখতেই হবে আত্মহত্যার প্রতি ভাবনাটাও বদলে গিয়েছে এখন। এখন তো আর অপরাধ নয় আত্মহত্যা। ফলে সমাজের কাছে নিজের মনের কথাটা পৌঁছে দেওয়ার সাহস কিছুটা বেড়েছে।’’ অর্থাৎ, প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন অন্য বহু জিনিসের ক্ষেত্রেই বদল এনেছে জীবনযাত্রায়, তেমনই বদল এনেছে মৃত্যুর আগের চিঠি লেখার রেওয়াজেও। কারণ, মনের কথা বলে ফেলার মাধ্যম এবং ধরন, বদলে গিয়েছে দুই-ই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE