চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি। ব্যান্ডেল-কাটোয়া রুটের লোকাল ট্রেনে কৌটো নাড়িয়ে ভিক্ষে করছেন জনাকয়েক ছাত্র। কারও কারও পরনে হাফপ্যান্টও। এমন সব ছেলেদের ভিক্ষে করতে দেখে কৌতুহলী যাত্রীরা জানতে চাইলেন, ‘‘ব্যাপার কী?’’
ছোটখাট চেহারার ছেলেটি এগিয়ে এসে জবাব দিয়েছিল, ‘‘আমাদের কলেজের স্যারেরা বেতন পাচ্ছেন না। তাই স্যারেদের মাইনে তুলতেই পথে নেমেছি।’’ টাকা যে খুব বেশি উঠেছিল, এমন নয়। কিন্তু বিনা টিকিটের ছাত্রদের রাতভর কাটোয়া জিআরপি-র হেফাজতে কাটাতে হয়েছিল। এ খবর নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষের কানে পৌঁছতে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এ কর্মকাণ্ডের হোতা চণ্ডী। কোন চণ্ডী?
নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নিমাই বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘তামাম বিশ্ব যাঁকে কার্টুনিস্ট হিসাবে চেনেন, ইনি সেই চণ্ডী লাহিড়ী।’’ নিমাইবাবু জানাচ্ছেন, নবদ্বীপকে ঘিরে চণ্ডীদার কর্মকাণ্ড তাঁর কার্টুনের মতোই বর্ণময়।
১৯৩১ সালের ১৫ মার্চ বুড়ো শিবতলায় মামার বাড়িতে জন্ম চণ্ডী লাহিড়ীর। বাবা মোহিনীমোহন লাহিড়ী ছিলেন বর্ধমান চণ্ডীপুরের বাসিন্দা। প্রথমে নবদ্বীপ হিন্দু স্কুল ও পরে বিদ্যাসাগর কলেজে পাশ করে তিনি পাড়ি দেন কলকাতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ করেন। তত দিনে হাতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি। কিন্তু শহরে গেলেও নবদ্বীপের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কখনও ফিকে হয়নি। নবদ্বীপের বিভিন্ন স্কুলের পত্র-পত্রিকায় স্মৃতিচারণে বহু বার তিনি লিখেছেন তাঁর নবদ্বীপ-কথা। কর্তৃপক্ষের অনুরোধে নবদ্বীপ হিন্দু স্কুলের শতবর্ষ, বিদ্যাসাগর কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তী, বকুলতলা প্রাক্তনী রজত জয়ন্তী, সারস্বত মন্দিরের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক পত্রপত্রিকায় তিনি এঁকেছেন প্রচ্ছদ ও কার্টুন। সঙ্গে একটি নাতিদীর্ঘ লেখাও। সে সব ছবি ও আঁকা আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছে নবদ্বীপ। মঠ-মন্দিরের শহরে সারস্বত মন্দির বহু পুরনো স্কুলগুলির অন্যতম। সে স্কুলের প্রধানশিক্ষক শচীন্দ্রমোহন নন্দীকে গুরু বলেই মানতেন চণ্ডীবাবু। ফলে হিন্দু স্কুলে পড়লেও সারস্বত মন্দিরের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল।
চণ্ডীবাবু লিখেছেন, ‘যারা লেখাপড়ায় ভাল, তাদের এই স্কুলে ভর্তি করা হত না। এটি ছিল উলট্পুরাণের দেশ। তুমি ভাল ছেলে। পাশ করে আইপিএস, আইসিএস, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার লক্ষ্য যদি থাকে তবে অন্য স্কুলে যাও। এখানে একটু কম মেধার ছেলেদের নেওয়া হয়। কারণ, এই স্কুলটির লক্ষ্য ইংরেজদের সেবা করা নয়, দেশসেবক তৈরি করা।’ ২০০৯ সালে স্কুলের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সেই লেখার সঙ্গে তিনি একটি কার্টুনও আঁকেন।
নবদ্বীপ মণিমেলার কর্মকর্তা শান্তিরঞ্জন দেব বলছেন, ‘‘আগামী ১৫ মার্চ, চণ্ডীদার জন্মদিনে তাঁকে সম্মাননা জানানো হবে বলে ঠিক হয়েছিল। তিনি আসবেন বলে কথাও দিয়েছিলেন। এই প্রথম চণ্ডীদা কথা রাখতে পারলেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy