Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সহারার টাকা পেতেন সৌরভ-সচিনও, যুক্তি মমতার

কুণালের দিকে কামান দাগলেন। আর ঢাল করতে চাইলেন সৌরভ-সচিনকে! কুণাল ঘোষ তাঁর দিকে সরাসরি আঙুল তোলার পরে প্রথম কোনও টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে এক দিকে যেমন প্রত্যাশিত ভাবেই দলের সাসপেন্ডেড সাংসদকে কয়েদি, জেলখাটা আসামি বলেছেন তিনি, তেমনই বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে দলের যোগ নিয়ে ওঠা অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে টেনে এনেছেন সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২০
Share: Save:

কুণালের দিকে কামান দাগলেন। আর ঢাল করতে চাইলেন সৌরভ-সচিনকে!

কুণাল ঘোষ তাঁর দিকে সরাসরি আঙুল তোলার পরে প্রথম কোনও টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে এক দিকে যেমন প্রত্যাশিত ভাবেই দলের সাসপেন্ডেড সাংসদকে কয়েদি, জেলখাটা আসামি বলেছেন তিনি, তেমনই বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে দলের যোগ নিয়ে ওঠা অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে টেনে এনেছেন সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ।

কী ভাবে?

সহারা সংস্থার কর্তা সুব্রত রায় এখন অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত প্রতারণার অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত। কিন্তু তিনিই দীর্ঘদিন ক্রিকেট টিমের মূল স্পনসর ছিলেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে মমতা বলেন, “সহারা কাপ কাদের? ক্রিকেট, ফুটবল তারা পরিচালনা করেনি? সচিন সহারা কাপ খেলেনি? সৌরভ খেলেনি? তাতে ওদের কী দোষ?” মুখ্যমন্ত্রীর এই কথাকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, পরের পর অভিযোগে নাজেহাল মুখ্যমন্ত্রী চাপ সামলাতে অবান্তর কথা বলছেন।

সম্প্রতি তাঁর দিকে সরাসরি আঙুল তুলেছেন কুণাল ঘোষ, তাঁর আমলের রেল-সারদা গোষ্ঠীর চুক্তিও সিবিআইয়ের নজরবন্দি। এই সময় সাক্ষাৎকারে কী বলতে পারেন মমতা, তা নিয়ে কৌতূহল ছিলই। দলের অন্য নেতা-নেত্রীরা যে সুরে কথা বলছেন, তেমন ভাবেই মমতা বলেছেন, “যে চোর, সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি তার হয়ে দালালি করছে! আসল অপরাধীকে আড়াল করছে। আর আমরা চোর ধরেছি। আদালতের নির্দেশে কমিশন করেছি। আমাদের বলছে চোর!” তিনি যে ‘চোর’ বলতে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকেই বুঝিয়েছেন, তাঁর কথাতেই তা স্পষ্ট। তৃণমূল নেত্রীর দাবি, “সারদার টাকা আমাকেও খেতে হয় না! দলকেও খেতে হয় না! তৃণমূল ভারতের মধ্যে সব চেয়ে স্বচ্ছ দল।” ওই সাক্ষাৎকার এ দিন সন্ধ্যায় সম্প্রচারিত হলেও তা অবশ্য নেওয়া হয়েছিল সারদা-কাণ্ডে প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা তথা তৃণমূল নেতা রজত মজুমদার সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে।

কালিম্পঙের ডেলোয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সুদীপ্তর বৈঠকের কথা চিঠি লিখে গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন কুণাল।

সেই চিঠির প্রসঙ্গ টেনেও মমতার ‘সততা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা। তার জবাবে মমতা এ দিন পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, “আমি নাকি কার সঙ্গে কথা বলেছি! দেখা করেছি! কোনও প্রমাণ আছে?” তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্য, কুণাল যে হেতু জেলবন্দি, তাই তাঁর কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মমতার কথায়, “একটা কয়েদি! জেলখাটা আসামি! যখন গ্রেফতার হয়নি, তখন বলত তৃণমূল সাংসদ বলে গ্রেফতার করছে না। তার পর গ্রেফতার হল। অন্যায় করেছে বলেই হল। এখন সে হয়ে গেল মহাপ্রভু! চোর তো বাঁচার জন্য যা-ইচ্ছে-তাই বলবেই!”

কেন্দ্রীয় অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অরুণ জেটলি, দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ-সহ বিজেপি-র একাধিক কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সাম্প্রতিক কালে কলকাতায় এসে সারদা প্রশ্নে মমতাকে আক্রমণ করেছেন। তাঁদের পাল্টা আক্রমণ করে এ দিন মমতা বলেন, “কেউ নেচে নেচে দিল্লি থেকে আসছে! দিল্লি থেকে আসতেই পারে। কিন্তু বলছে, সব ক’টাকে জেলে পুরব! এত বড় সাহস! এত ঔদ্ধত্য! এত সাহস হয় কী করে! মিথ্যে কথা বললে মানুষ জিভ টেনে খুলে নেবে!” অমিতের নাম না করে তাঁর প্রতি মমতার হুঁশিয়ারি, “জেলে পুরবে! তারা তো নিজেরাই জেল খেটে বাংলায় আসছে! কেসকর্ম দাঙ্গা, কো-অপারেটিভ, পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া, সব আমার কাছেও আছে। পেন ড্রাইভে। গুজরাতের লোকেরা আমায় দিয়ে গেছে। ওখানে আমার বন্ধুরা নেই ভাববেন না! আমি ওদের ভালবাসি।”

বিজেপি-র তরফে বলা হচ্ছে, সারদায় প্রতারিত হয়েছেন ১৭ লক্ষ মানুষ। মমতার দাবি, সংখ্যাটা ১২ লক্ষ। তার মধ্যে ৫ লক্ষ প্রতারিতকে সরকার টাকা ফেরত দিয়েছে। তৃণমূল নেত্রী বলেন, “বাকি ৭ লক্ষ মানুষের টাকা নিশ্চয়ই সিবিআই বা অরুণ জেটলি ফেরত দেবেন। আর দিল্লির নাকের ডগায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি করেছে একটা সংস্থা। জেটলি সাহেব কী বলছেন?”

সারদা-তদন্তে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) যে তৃণমূল সাংসদ, নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অপর্ণা সেনকে জেরা করেছে, সেই প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন মমতা। বলেছেন, “অর্পিতা সারদা পরিচালিত মিডিয়ায় সাংবাদিক ছিলেন মাত্র। অপর্ণা সেন সারদা পরিচালিত একটি পত্রিকা শুধু সম্পাদনা করতেন। কে কোথা থেকে টাকা এনে ব্যবসা করছে, তা তাঁরা জানতেন না। জানার কথাও নয়।” সারদার টাকায় কয়েকটি ক্লাবের আচমকা শ্রীবৃদ্ধি (যে তালিকায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী কেন্দ্র ভবানীপুরের বেশ কিছু ক্লাবও আছে) প্রসঙ্গ ইঙ্গিত করে মমতার বক্তব্য, “কেউ টাকা দিতে চাইলে ক্লাবগুলো নেবে না কেন? তাদের কী দোষ? তারা কী করে জানবে টাকা কোথা থেকে আসছে?”

মুখ্যমন্ত্রীর এ সব কথা শুনে বিরোধীরা স্বভাবতই প্রশ্ন তুলেছে, তৃণমূল নেত্রী ও তাঁর দল যদি নির্দোষই হবে, তা হলে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে এত রাজনৈতিক আক্রমণ কেন? কেনই বা সিবিআই দফতরের সামনে ধর্না? তাদের আরও প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি টাকা নেওয়ার কথা কেউ এখনও বলেনি। কিন্তু সারদার সংবাদমাধ্যমের সম্পূর্ণ সুযোগ যে তৃণমূল নিয়েছে, এমনকী, ওই সংস্থার দেওয়া অ্যাম্বুল্যান্সও রাজ্য সরকার ব্যবহার করেছে। সে ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী চুপ কেন? ডেলো বৈঠক নিয়ে সরাসরি জবাব না দিয়ে কুণালকে কেন আক্রমণ করা হল?

বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রশ্ন, “উনি রেলমন্ত্রী থাকাকালীন আইআরসিটিসি-র সঙ্গে সারদার যে চুক্তি হয়, তা নিয়ে কোনও কথা বললেন না কেন মমতা?” তাঁর দাবি, সারদা-সহ ওই ধরনের আরও কোন কোন সংস্থার লোকজনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর যোগাযোগ ছিল বা আছে, তা জানতে তাঁর মোবাইলের কল-লিস্ট খতিয়ে দেখুন গোয়েন্দারা। তিনি বলেছেন, আমরা তো ওঁর বা ওঁর দলের বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। বলছেন ওঁরই দলের কুণাল, রজত! আমরা শুধু তার প্রেক্ষিতে তাঁর ব্যাখ্যা চাইছি!”

বন্ধ কল-কারখানার প্রসঙ্গ তুলে রাহুলবাবু এ-ও বলেছেন, “ওঁর জমানায় এত কারখানা বন্ধ হচ্ছে। চা-বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। কোনও বন্ধ শিল্পের শ্রমিকদের সাহায্য করতে তো মুখ্যমন্ত্রী এগিয়ে আসেন না! সারদারই সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের ত্রাণ দেওয়া হয়েছে! এটা আরও একটা দুর্নীতি! এই নিয়ে কী বক্তব্য তাঁর?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও বলেছেন, “জেসপ বন্ধ হতে তো তার শ্রমিকদের জন্য ওঁর প্রাণ কাঁদে না! তা হলে সারদার জন্য ত্রাণ তহবিল কেন?”

সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের প্রশ্ন, “নিজের যদি কোনও ভয়ই না থাকবে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর তো উচিত তদন্তে সহযোগিতা করা! তার বদলে সিবিআই দফতরের সামনে ধর্না দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে হচ্ছে কেন?” সেলিমের আরও বক্তব্য, “ওঁর কথায় সন্দেহ হচ্ছে, ডেলোর বৈঠকের নথি-প্রমাণ সব লোপাট করা হয়ে গিয়েছে হয়তো! এত দিন সিট কী কাজ করল?” আর কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের মন্তব্য, “নির্দোষ হলে উনি সিবিআইকে স্বাগত জানান! তা না করে সিবিআইয়ের দফতরের সামনে ধর্না কীসের ইঙ্গিত?”

বিরোধীদের এই আক্রমণের মধ্যে তৃণমূল নেত্রীর হয়ে ময়দানে নেমেছেন তাঁরই মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। মমতার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে তাঁর মন্তব্য, “চাঁদের কলঙ্ক থাকতে পারে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলঙ্ক থাকতে পারে না! তিনি কোনও অন্যায়, অসৎ কাজ করতে পারেন না!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE