ব্যবধান এ বার পঞ্চাশের গণ্ডিও ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম!
কর্মীদের মহার্ঘভাতা (ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স, সংক্ষেপে ডিএ) দেওয়ার দৌড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় রাজ্য সরকার পিছিয়ে রয়েছে অনেক দিনই। তবে ফারাকটা এত প্রকট হয়নি। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় কর্মীদের তুলনায় ৪৮% কম ডিএ পাচ্ছেন। উপরন্তু নবান্নের খবর, প্রথা মেনে চলতি মাসে আরও ৬%-৭% ডিএ ঘোষণা করতে চলেছে মোদী সরকার, যা কার্যকর হবে গত জুলাই থেকে। উল্টো দিকে পুজোর আগে রাজ্যে বকেয়া ডিএ-র এক কিস্তিও মেটানোর পরিকল্পনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের নেই বলে অর্থ দফতরের ইঙ্গিত।
ফলে কেন্দ্র-রাজ্য ডিএ’র ব্যবধান ৫০% টপকানো স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এ হেন বেনজির পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে কর্মী-ক্ষোভের আঁচও ভাল মতো মালুম হচ্ছে রাজ্য সরকারের অন্দরে। এই হাল কেন?
রাজ্যের অর্থ-কর্তাদের ব্যাখ্যা: প্রথামাফিক কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি সাধারণত বছরে দু’কিস্তি ডিএ দেয়। বাম জমানার পশ্চিমবঙ্গেও রেওয়াজটা মোটামুটি বহাল ছিল। কিন্তু পালাবদলের পরে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক বছরে এক কিস্তির বেশি ডিএ মিলছে না। তাই ব্যবধান বাড়ছে চড়চড়িয়ে। বাম আমলের শেষ বছরে যেখানে ফারাক ছিল ১৬%, এখন সেটাই এখন তিন গুণ বেড়ে ৪৮%।
এবং তা কমারও বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এক অর্থ-আধিকারিকের পর্যবেক্ষণ বলছে, গত জানুয়ারিতে রাজ্য-কর্মীরা এক কিস্তি ডিএ পেয়েছেন। সুতরাং পুজোর আগে তো বটেই, চলতি বছরে আর ডিএ-র আশা না-করাই ভাল। নবান্নের নিয়মে আগামী বছরের জানুয়ারিতে এক কিস্তি ডিএ ঘোষণার কথা। ‘‘তবে আগামী বছরের এপ্রিল-মে’তে বিধানসভার ভোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তার আগে বাড়তি এক কিস্তি মিললেও হয়তো মিলতে পারে।’’— বলছেন তিনি।
তেমন হলে ব্যতিক্রম ধরতে হবে। কিন্তু বছরে নিয়মিত দু’কিস্তি ডিএ দিতে অসুবিধে কোথায়?
নবান্নের শীর্ষ মহলের দাবি: বাম জমানায় নেওয়া বিপুল ঋণ শুধতেই সরকারের আয়ের বড় অংশ বেরিয়ে যাচ্ছে। বছরে এক কিস্তি ডিএ, বাৎসরিক বেতনবৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) ও বোনাস দেওয়ার পরে কোষাগারে বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। অর্থ দফতরের হিসেবে, রাজ্য সরকারের কয়েক লক্ষ কর্মীকে এ বার বোনাস-এক্সগ্রাসিয়া দিতে চারশো কোটি টাকা লেগেছে। পাশাপাশি মূল বেতনের ৩% হারে ইনক্রিমেন্ট দিতে মাসে ১০০ কোটি খরচের বাড়তি বোঝা চেপেছে। দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘চলতি অর্থবর্ষের বাজেটে বেতন-পেনশন খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৭%। তবু ইনক্রিমেন্ট আর বোনাস দিয়ে যা পড়ে থাকছে, তা দিয়ে দু’কিস্তি ডিএ সম্ভব নয়।’’ অর্থ-আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, রাজ্যে ১% ডিএ দিতে মাসে ২৫ কোটি টাকা দরকার। বকেয়া ৪৮% মেটাতে হলে বছরে ১৬ হাজার কোটি লাগবে। ‘‘কোষাগারের যা দশা, তাতে এটা স্বপ্নবিলাস।’’— মন্তব্য এক অফিসারের।
সরকারি যুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছে প্রায় প্রতিটি কর্মী সংগঠন। তাদের পাল্টা যুক্তি: ঋণ মেটাতে বহু টাকা বেরিয়ে গেলেও মেলা-খেলা, উৎসব-ইনামে ফি বছর কোটি কোটি টাকা খরচে খামতি দেখা যাচ্ছে না। ‘‘শুধু কর্মীদের বকেয়া মেটানোর সময়েই অভাবের দোহাই কেন?’’— প্রশ্ন বিভিন্ন কর্মী-নেতার। শুধু বিরোধী নয়, বকেয়া ডিএ প্রসঙ্গে সরকারপন্থী ইউনিয়নগুলোর মধ্যেও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। যাতে ইন্ধন দিচ্ছে কেন্দ্রীয় কর্মীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামোর তোড়জোড়। কী রকম?
সরকারি সূত্রের খবর: আগামী ১ জানুয়ারি কেন্দ্রে সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ বলবৎ হতে চলেছে। এতে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের প্রাপ্তি এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এ দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও ষষ্ঠ বেতন কমিশনই গড়ে উঠতে পারেনি! বাম আমলে, ২০০৮-এর এপ্রিলে রাজ্য-কর্মীদের জন্য পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হয়েছিল। সেটাই শেষ।
এমতাবস্থায় ডিএ-ঘাটতি যুক্ত হলে চার মাস বাদে কেন্দ্রীয় কর্মীদের সঙ্গে রাজ্য-কর্মীদের বেতনের ফারাক ‘আকাশছোঁয়া’ হয়ে দাঁড়াবে বলে গুঞ্জন-অনুযোগ শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন দফতরে। কর্মীদের অসন্তোষ সম্পর্কে কর্তারা অবশ্য সম্যক অবহিত। তবু নবান্নের তরফে সুরাহার নির্দিষ্ট আশ্বাস এখনও নেই। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের বরাবরের বক্তব্য, ‘‘সরকার যখন সমর্থ হবে, তখনই ডিএ দেবে। সরকারি কর্মীদের প্রতি আমাদের পূর্ণ আনুগত্য রয়েছে।’’ মমতা সরকার ষষ্ঠ বেতন কমিশন গড়বে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরেও অমিতবাবুর জবাব, ‘‘এখনই স্পষ্ট কিছু বলা যাচ্ছে না। যখন সময় হবে, বলব।’’
সেই সময় কবে হবে, কিংবা আদৌ হবে কিনা, কর্মচারী মহলে আপাতত তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy