Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ডিএ ঘোষণা, তবে পেতে বছর ঘুরবে

দু’দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার ৬% মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) ঘোষণা করায় ঘরে-বাইরে তাঁর উপর প্রবল চাপ তৈরি হয়েছিল। কারণ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের ডিএ-র ফারাক এর ফলে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৪%-এ।

ডিএ ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর।

ডিএ ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

দু’দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার ৬% মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) ঘোষণা করায় ঘরে-বাইরে তাঁর উপর প্রবল চাপ তৈরি হয়েছিল। কারণ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের ডিএ-র ফারাক এর ফলে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৪%-এ। আর কোনও রাজ্যে ফারাকটা এত বেশি ছিল না। সেই চাপের মুখে রাজ্য সরকারি কর্মীদের তুষ্ট করতে শুক্রবার ১০% ডিএ ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কিন্তু কতটা সুরাহা হল এতে? এই ঘোষণায় ফারাকটা কি কমবে?

কেন্দ্রের ঘোষিত ডিএ কিন্তু বলবৎ হচ্ছে গত জুলাই মাস থেকে। আর মমতা জানিয়েছেন— এখনই নয়, আগামী বছর জানুয়ারি মাসের বেতনের সঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মীরা ওই বাড়তি মহার্ঘ ভাতা পাবেন। কর্মীদের বক্তব্য, ওই একই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কর্মীদের জন্য আরও এক কিস্তি ডিএ ঘোষণা করবে। ফলে ব্যবধান আদৌ কমছে না। হাফ সেঞ্চুরির ওপরেই থাকবে সেটা।

এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর দ্বিতীয় ঘোষণা ছিল— বেতন কাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে অক্টোবর মাসে ষষ্ঠ পে কমিশন গঠন হবে। কমিশন কবে তাদের সুপারিশ জমা দেবে, তা অবশ্য জানাননি মমতা। নবান্নের শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে পে কমিশন গঠনের পর তার সুপারিশ কার্যকর করতে দেড় থেকে দু’বছর সময় লেগে যায়। সেই হিসেবে ২০১৭ সালের আগে কারও পক্ষেই কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরা সপ্তম পে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ীই আগামী ১ জানুয়ারি থেকে নতুন হারে বেতন পাবেন।

ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা শুনে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম-ফেরত শাসক দলের কর্মী সংগঠনের বহু সমর্থককে বলতে শোনা যায়, ‘‘অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, পুজোর আগে অন্তত এক কিস্তি ডিএ পাবো। কিন্তু কোথায় কী!’’ কেউ কেউ বলেন, ‘‘দিল্লি কা লাড্ডু ধরিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী।’’ তাঁদের বক্তব্য, এই ঘোষণাটা প্রতি বার জানুয়ারিতে হয়। এ বার প্রায় চার মাস আগে করা হল। পার্থক্য বলতে এইটুকুই। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার আগেই এ দিন অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোনও রকম রাখঢাক না-করে সরাসরি ডিএ-র দাবি তোলেন তৃণমূলের কর্মী ফেডারেশনের নেতা তপন ঘড়াই। মুখ্যমন্ত্রী তখনও স্টেডিয়ামে ডোকেননি। তপনবাবুর ওই কথা শুনে হাততালির ঝড় বয়ে যাওয়ায় অস্বস্তিতে পড়ে যান শিক্ষামন্ত্রী, পঞ্চায়েত মন্ত্রীরা। তপনবাবু মঞ্চ থেকে নামার পরে তাঁকে মঞ্চের পিছনে নিয়ে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী উত্তেজিত ভাবে কিছু বলতে থাকেন।

উচ্ছ্বসিত কর্মীরা।

মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণাকে ‘নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ’ বলে অভিযোগ তুলেছে রাজ্য বামফ্রন্ট। আগামী ৩ অক্টোবর বিধাননগর ও আসানসোল পুর নিগম, হাওড়া পুরসভার ১৬টি ওয়ার্ড এবং শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নির্বাচন ঘোষণা হয়েছে। ভোটের আচরণবিধি কার্যকর হয়েছে ৩ সেপ্টেম্বর। সেই বিধি ভঙ্গ করে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী সরকারি কর্মীদের জন্য আর্থিক সুবিধা সংক্রান্ত একগুচ্ছ বিষয় ঘোষণা করেছেন বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছে বামফ্রন্ট। অভিযোগের আইনগত দিক খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন কমিশনার। শাসক দলের অনুগত কর্মীদের সভায় মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে সরকারি ঘোষণা করেন— তা নিয়েও সরব বিরোধীরা।

বকেয়া ডিএ-র দাবিতে বহু দিন ধরেই সরব হচ্ছেন বিভিন্ন কর্মী সংগঠন। গত বুধবার কেন্দ্রীয় সরকার এক কিস্তি মহার্ঘভাতা ঘোষণা করায় সেই ক্ষোভের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ক্ষোভ ছড়ায় শাসক দলের কর্মী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও। এই প্রেক্ষাপটে এ দিন মমতা কী ঘোষণা করেন, তা নিয়ে রাজ্য কর্মীদের মধ্যে কৌতূহল তুঙ্গে উঠেছিল। এ দিন কাজকর্ম লাটে তুলে ইন্ডোর স্টেডিয়াম ভরিয়ে ‘ভাল খবর’ শুনতে হাজির হয়েছিলেন কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহারের কর্মীরা। ডিএ ঘোষণা করে মমতা বলেন, ‘‘আমি মানবিক, আমি দানবিক নই। আমি কোনও দিন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিই না। আমার যা ক্ষমতা, সেই অনুযায়ী আপনাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাব।’’ মমতার দাবি— তিনি ভোটের জন্য কোনও দিন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ভোটের কথা ভেবে মিথ্যা ঘোষণা করে দিয়ে চলে যাব। আমাকে ভোট দিলেন, তার পর আপনাদের বেতন বন্ধ হয়ে গেল। তখন কি হবে!’’

কেন এর বেশি কিছু করতে পারছেন না, তাঁর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পুরনো কথাই টানেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘এই সরকারের ঘাড়ে বিপুল দেনা চাপিয়ে গিয়েছে বাম সরকার। প্রতি মাসে ২৮ হাজার কোটি টাকা কেটে নিচ্ছে কেন্দ্র। যেটুকু বেঁচে থাকছে, তা দিয়ে কর্মীদের বেতন দিই, রাজ্যের উন্নয়নও করি। মনমোহন সরকার আমাদের কিছু দেয়নি, বিজেপি সরকারও না।’’ তাঁর দাবি, এই আর্থিক পরিস্থিতিতেও তাঁর সরকার মাস-পয়লা বেতন দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘রাজ্যের ঋণের কারণে কেন্দ্র ওই টাকা কেটে না-নিলে আমি কর্মীদের যাবতীয় বকেয়া মিটিয়ে দিতাম। হাতে টাকা নেই তাই করা যাচ্ছে না।’’ তাঁর দাবি, এক জন সরকারি কর্মীকে ৬ জনের কাজ করতে হয়। তাই ক্ষমতায় এসে তাঁর সরকার নানা সরকারি পদে লোক নিয়োগ শুরু করেছে। আগামী দিনে আরও ২ লক্ষ নিয়োগ করা হবে।

মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সরকারি কর্মীরা এখন থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রাজ্যের যে কোনও জায়গায় ‘এইচটিসি’ (হোম ট্র্যাভেল কনসেশন) নিয়ে বেড়াতে যেতে পারবেন। আর প্রতি দশ বছর অন্তর ‘এলটিসি’ (লিভ ট্র্যাভেল কনসেশন) নিয়ে দেশের যে কোনও রাজ্যের পাশাপাশি নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, তাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ায় বেড়াতে যেতে পারবেন। দু’টি ক্ষেত্রেই কর্মীদের যাতায়াত খরচ দেবে রাজ্য। কর্মীদের প্রশ্ন— বিদেশ যাওয়ার জন্য সরকার যাতায়াতের ভাড়া দেবে। কিন্তু ওখানে থাকা-খাওয়ার খরচ কে জোগাবে? এক কর্মী বলেন, ‘‘আগুন বাজারে সবার পেটে ভাত জোটাতে পারছি না, সরকার বলছে বিদেশে বেড়াতে যাও!’’ অনেকে এই প্রশ্নও তুলেছেন, যাঁরা চাকরি জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে তাঁরা কী পেলেন? সরকারি কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দেখার জন্য অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে মাথায় রেখে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী গঠনেরও কথাও জানান মমতা। কিন্তু সেই সুযোগ-সুবিধা ঠিক কী ধরণের— তা পরিষ্কার জানাননি তিনি।

মুখ্যমন্ত্রীর একগুচ্ছ ঘোষণাকে কটাক্ষ করে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা এবং বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘আজ মুখ্যমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক রসিকতা করলেন! আমার ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে সরকারি কর্মীদের এমন ভাবে ঠকতে দেখিনি।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘২০১১ সালে রাজ্যে সর্বাধিক ডিএ বকেয়া ছিল ১৬%। মুখ্যমন্ত্রী সরকারি কর্মীদের মন ভোলানোর চেষ্টা করলেন।’’ আইএনটিইউসি অনুমোদিত কনফেডারেশন অফ স্টেট গর্ভমেন্ট এমপ্লয়িজ-এর নেতা মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর যে সদিচ্ছা নেই তা তাঁর ঘোষণাতেই স্পষ্ট।’’ বিজেপি প্রভাবিত কর্মী সংগঠনের সম্পাদক সঙ্কেত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সরকারি কর্মীদের বঞ্চনার হাফ সেঞ্চুরি রয়েই গেল।’’ শাসক দলের কর্মী সংগঠনের কোনও নেতা অবশ্য প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হননি।

তবে সভা-শেষ শাসক-সমর্থক কর্মীদের একটা বড় অংশ তথ্য দিয়ে জানান, জানুয়ারি থেকে ১০% ডিএ পেলে কেন্দ্রীয় কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের ব্যবধান কমে দাঁড়াবে ৪৪%। কিন্তু ওই মাসেই কেন্দ্রের আরও এক কিস্তি ডিএ ঘোষণা করার কথা। তা হলে ব্যবধান সেই ৫০-৫১%-এই গিয়ে দাঁড়াবে। তাঁদের প্রশ্ন— এতে কী লাভ হল?

— নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE