Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নিচুতলার চাপেই মঞ্চ প্রায় বাঁধা

বাংলায় জোটের ব্যাপারে রাহুল গাঁধী বা প্রকাশ কারাটরা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেননি ঠিকই। কিন্তু দুই শিবিরের বড় অংশের নেতাদের মতে, বিষয়টি এখন কার্যত ‘আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি’-র স্তরে এসে গিয়েছে।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৯
Share: Save:

বাংলায় জোটের ব্যাপারে রাহুল গাঁধী বা প্রকাশ কারাটরা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেননি ঠিকই। কিন্তু দুই শিবিরের বড় অংশের নেতাদের মতে, বিষয়টি এখন কার্যত ‘আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি’-র স্তরে এসে গিয়েছে। কারণ বাম-কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে যে প্রবল জোটের হাওয়া উঠেছে, তা হাইকম্যান্ড বা পলিটব্যুরো— কারও পক্ষেই আর অস্বীকার করা সম্ভব নয়। একই ভাবে উপেক্ষা করা যাবে না জোটের পাটিগণিতও। বরং অঙ্কের হিসেব বলছে, জোট না করে আলাদা ভাবে ভোট ময়দানে নামলে বাংলায় অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে পারে কংগ্রেস-সিপিএম দু’পক্ষই!

তা হলে চূড়ান্ত ঘোষণায় দেরি হচ্ছে কেন? রাজনৈতিক সূত্রের মতে, মতাদর্শগত জামাটা নিভাঁজ রেখে জোটের জন্য কী তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া হবে, তা ঠিক করতে সময় নিচ্ছে সিপিএম। তাই আগামী সপ্তাহে কলকাতায় রাজ্য কমিটির বৈঠকের পর এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লিতে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। এ দিনই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র শিলিগুড়িতে বলেন, ‘‘শীর্ষ স্তরে কী ঠিক হবে জানি না, আপনারাও (সংবাদমাধ্যম) জানেন না। তবে মানুষের জোট হচ্ছেই। যত দিন যাচ্ছে সেই জোটের শক্তি বাড়ছে।’’

একই ভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জোটের পাটিগণিত যাচাই করে দেখছেন রাহুল-সনিয়াও। দলের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, জোট বাস্তবায়নের সূত্র বের করতে গত সপ্তাহেই কথা বলেছেন রাহুল এবং সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। পরে আবার সংসদ ভবন চত্বরে ইয়েচুরির সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং এআইসিসি-র তরফে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত সি পি জোশী।

অথচ দু’মাস আগেও পরিস্থিতিটা এমন ছিল না। একদিকে যেমন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মহম্মদ সেলিমরা জোট হলে কংগ্রেসের ভোট পাওয়া নিয়ে সংশয়ে ছিলেন, তেমনই জোটের কথা বলে দলে কিছুটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন আবদুল মান্নান, প্রদীপ ভট্টাচার্য, ওমপ্রকাশ মিশ্ররা। কিন্তু দলের নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে থেকেই জোটের জন্য তীব্র চাপ তৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি উল্টে গিয়েছে।

এআইসিসি-র এক সাধারণ সম্পাদক আজ জানান, এমনিতেই জোট-প্রশ্নে রাজ্যস্তর থেকে উঠে আসা দাবি মানতে শুরু করেছেন রাহুল। কারণ, তাঁর মতে আঞ্চলিক নেতৃত্বের বক্তব্য ও দাবিকে গুরুত্ব না দেওয়াতেই গত দেড় দশকে রাজ্যে রাজ্যে আরও দুর্বল হয়েছে কংগ্রেস। তা ছাড়া বহু ক্ষেত্রেই এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিচুতলার মত মানতে হচ্ছে নানা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে। যে কারণে, লালকৃষ্ণ আডবাণী-রাজনাথ সিংহরা চাইলেও দলের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর উত্তরণ ঠেকাতে পারেননি। আবার লালু প্রসাদের সঙ্গে হাত মেলানোর ব্যাপারে এ বার বিহার ভোটের মাস তিনেক আগেও গররাজি ছিলেন রাহুল। মহাজোটে আগ্রহী হয়েও নীতীশ কুমারের নেতৃত্ব মানতে রাজি ছিলেন না লালু। কিন্তু নিচুতলার কর্মীদের জোটের দাবি ও তার পাটিগণিত অস্বীকার করতে পারেননি রাহুল বা লালু কেউই। বিহার ভোটে সেই পাটিগণিতই উতরে দিয়েছে।

কংগ্রেসের ওই কেন্দ্রীয় নেতার মতে, পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোট নিয়ে দু’দলের কেরল-লবির আপত্তিও ধোপে টেকে না। ওই নেতার কথায়, ‘‘এই জোটের জন্য কেরলে অস্বস্তি তৈরি হলে দু’পক্ষেরই হবে। তাই এটা ‘জিরো সাম গেম’।’’

রাহুলের ঘনিষ্ঠ সূত্রে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিটাও রাজ্য নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। অধীর যেমন রাহুলকে জানিয়েছেন, জীবনভর সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও এখন তাদের সঙ্গে জোটের জন্য নিচুতলার কর্মীদের দাবিকে অগ্রাহ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আবার জোটের পাটিগণিত সনিয়া-রাহুলকে বুঝিয়েছেন ওমপ্রকাশ মিশ্র। তাঁর হিসেব মতো, জোট হলে কংগ্রেস ও বামেরা মিলে রাজ্যের অন্তত ১৭০টি আসনে জিততে পারে। তৃণমূলের মূল শক্তি দক্ষিণবঙ্গে। জোট হলে শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলিতে তৃণমূল বড় বাধার মুখে পড়বে। একমাত্র দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গায়ের জোরে আসন ধরে রাখতে পারবে শাসক দল।

রাজ্য নেতারা রাহুলকে এও জানিয়েছেন, আসন্ন ভোটে প্রার্থী বাছাই নিয়ে চাপে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চতুর্মুখী লড়াই হলে তৃণমূলের বর্তমান বিধায়কদের অনেককেই টিকিট না দেওয়ার ইচ্ছা মমতার। কারণ এঁদের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্তরে যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু জোট হলে এঁদের বাদ দেওয়ার ঝুঁকি নেবেন না মমতা। তা ছাড়া যে সব আসনে বর্তমানে তৃণমূলের বিধায়ক নেই, সেখানেও টিকিটের প্রচুর দাবিদার। জোট হলে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ রাজনীতিরও সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। ঘটনাচক্রে এ দিনই নিজের বাড়িতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, ওই জেলায় তৃণমূলের ২৬ জন বর্তমান বিধায়কদের সকলকেই ফের টিকিট দেওয়া হবে।

তবে রাহুল ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘সমস্যা হল, পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসে এখন ওজনদার নেতার অভাব। তাই বর্তমান নেতাদের সব সময় গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না সনিয়া-রাহুল।’’ তিনি জানান, পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে রাজ্যের মানুষের মুডও বুঝে নিচ্ছেন রাহুল। সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গেও কথা চালাচ্ছেন। বিহার ভোটের সময়ও আনুষ্ঠানিক জোট ঘোষণার আগে গুলাম নবি আজাদকে গোপনে দূত করে ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ করেন রাহুল। তার পর দুম করে এক দিন পটনায় জোটের ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল। বাংলাতেও তেমন চমকের সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দিচ্ছেন না কংগ্রেসের অনেকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shankhadeep das
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE