Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আদর নেই, বাঘরোলের মাথায় বাড়ি

বাঘ নয় সে। তবে বাঘের মাসি। বোনপোর মতো জাতীয় পশু নয় সে। তবে তার একটি নামের মধ্যে বাঘা গোত্রপরিচয়টা স্পষ্ট। সেই নামটা হল বাঘরোল। পশ্চিমবঙ্গের ‘স্টেট অ্যানিম্যাল’ বা রাজ্য-পশুর তকমা রয়েছে তারই। তবু বাঘরোল বা মেছোবেড়ালদের কপাল বেজায় মন্দ!

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৭
Share: Save:

বাঘ নয় সে। তবে বাঘের মাসি। বোনপোর মতো জাতীয় পশু নয় সে। তবে তার একটি নামের মধ্যে বাঘা গোত্রপরিচয়টা স্পষ্ট। সেই নামটা হল বাঘরোল। পশ্চিমবঙ্গের ‘স্টেট অ্যানিম্যাল’ বা রাজ্য-পশুর তকমা রয়েছে তারই। তবু বাঘরোল বা মেছোবেড়ালদের কপাল বেজায় মন্দ!

গেরস্থের পুষ্যি বেড়ালদের মতো আদিখ্যেতা জোটে না। নামে বাঘের গন্ধ থাকলেও বোনপো বাঘের মতো ওজনদার নায়কের ভাবমূর্তিও নেই তাদের। পাড়াগাঁয়ের জলা, ডোবা-পুকুর এবং দিঘির পাড়ে ঝোপঝা়ড়ের এই মছলিখোর আবাসিকেরা পশুকুলে নেহাতই ব্রাত্যজন।

বাঘরোলের আবাস পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে। কিন্তু এ রাজ্যের ঠিক কোথায় কোথায় মেছোবে়ড়ালদের বসতি, সাকুল্যে সংখ্যাই বা কত, তাদের টিকে থাকার পথে কোনও বিপদ ঘনাচ্ছে কি না— এ-সবের নির্দিষ্ট তথ্য নেই রাজ্যের বন দফতর এবং জীববৈচিত্র পর্ষদের হাতে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের ‘স্টেট অ্যানিম্যাল’ বিপন্ন হয়ে পড়েছে কি না, সেটুকুও জানা নেই সরকারি কর্তাদের।

বাঘের মাসির ঠিকুজি

• নাম: মেছো বেড়াল

• বৈজ্ঞানিক নাম: প্রায়োনেইলুরাস ভিভেরিনাস

• বাসস্থান: জলাভূমির ঝোপঝাড়

• খাবার: প্রধানত মাছ, তবে মাংসও চলে

• আকার: তিন-সাড়ে তিন ফুট লম্বা

• ওজন: পুরুষ ১৫-১৮ কেজি, মাদি ৬-৮

রাজ্য বন্যপ্রাণ শাখার এক পদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘মেছোবেড়াল নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে রাজ্যের সর্বত্রই ওদের দেখা যায়।’’ যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের রিপোর্ট বলছে, ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ায় মেছোবেড়াল ওরফে বাঘরোলের সংখ্যা কমছে। তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘সঙ্কটাপন্ন’ হিসেবে।

মাছেভাতে বাঙালির সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসে বেশ মিল মেছোবেড়ালের। বন দফতরের একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, সত্তরের দশকে বাংলার রাজ্য-পশুর তকমা জোটে এই মাছখেকোদের কপালে। ২০১২ সালে জীববৈচিত্র নিয়ে বিশ্ব সম্মেলনের আগে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি লিখে মেছোবেড়ালের সেই খেতাবের কথা ঘোষণাও করা হয়েছিল। তার পরেও এদের সংরক্ষণে কোনও তাগিদ নেই কেন, প্রশ্ন তুলেছেন বন্যপ্রাণপ্রেমীরা।

বন দফতর সূত্রের খবর, বছর তিনেক আগে বাঘ, গন্ডার, হাতির সঙ্গে সঙ্গে মেছোবেড়াল, হায়নার মতো প্রাণীদের উপরেও সমীক্ষার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।

বন্যপ্রাণপ্রেমীদের অনেকেই বলছেন, প্রশাসনের কাছে মেছোবেড়ালদের কদর না-থাকায় তাদের সংরক্ষণ নিয়েও তৎপরতা নেই। তার ফল কী হতে পারে, সেটা বছরখানেক আগে টের পেয়েছিলেন পরিবেশপ্রেমীরা। হাওড়ার একটি গ্রামে মেছোবেড়াল মেরেই ক্ষান্ত হননি কয়েক জন যুবক। সেই মরা বাঘরোলের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকেও দিয়েছিলেন। তাতে ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ কম পড়েনি। সেই ছবি দেখে বন্যপ্রাণপ্রেমীরা হইচই শুরু করায় ধরপাকড় করে বন দফতর। সপ্তাহ দুয়েক আগে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের কাছে এক গ্রামেও মেছোবেড়াল পিটিয়ে মারা হয়েছে।

মেছোবেড়াল সংরক্ষণে উদ্যোগী প্রাণী-গবেষক তিয়াষা আঢ্যের মতে, নগরায়ণের ফলে গ্রামাঞ্চলেও জলা কমছে। তাতে বাসস্থান এবং খাবারের সমস্যায় পড়ছে মেছোবেড়ালেরা। মুরগি, ছাগল মেরে মানুষের কোপে পড়ছে তারা। বাঘরোল মারা যে অপরাধ, সেই ব্যাপারে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। ‘‘বাঘ এবং বাঘরোল দু’টিই বন্যপ্রাণ আইনে প্রথম তফসিলভুক্ত প্রাণী। ফলে আইনের চোখে বাঘ মারা এবং বাঘরোল মারা সমান অপরাধ,’’ বলছেন তিয়াষা।

রাজ্য জীববৈচিত্র পর্ষদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, হাওড়া ও হুগলির কিছু এলাকায় মেছোবেড়ালদের বড় ধরনের বসতি রয়েছে। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং পর্ষদের ব্লক কমিটির সদস্যেরা বিক্ষিপ্ত ভাবে কাজ করছেন সেখানে। তাঁদের সমীক্ষাতেও মেছোবেড়ালের সঙ্কট প্রকট। হাওড়ার পাঁচলা ব্লক জীববৈচিত্র কমিটির সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ আদক বলছেন, ‘‘এখানে মেছোবেড়ালদের সংখ্যা কমছে। ওদের বাঁচাতে আরও তৎপরতা প্রয়োজন।’’ তিয়াষাও মনে করেন, শুধু বন দফতর নয়, সক্রিয় হতে হবে জেলা পরিষদ এবং অন্যান্য সরকারি দফতরকেও। জলাভূমি আইনেও সংশোধনী দরকার।

‘স্টেট অ্যানিম্যাল’ নিয়ে কোনও সমীক্ষা রিপোর্ট না-থাকাটা যে বড় ধরনের খামতি, সেটা কার্যত মেনে নিয়েছেন রাজ্য জীববৈচিত্র পর্ষদের চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যালও। তাঁর কথায়, ‘‘স্টেট অ্যানিম্যাল অথচ তার সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই— এটা শুনতে মোটেও ভাল লাগে না।’’ অশোককান্তিবাবু জানান, রাজ্য জুড়ে মেছোবেড়াল নিয়ে সমীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে প্রস্তাবও জমা পড়েছে। শীঘ্রই এই সমীক্ষার কাজ শুরু হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fishing Cat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE