প্রতীকী ছবি।
স্বাস্থ্যের স্বাস্থ্য ফেরাতে এ বার ডাক্তারদের ‘স্বাস্থ্যকর’ প্রতিযোগিতায় সামিল করতে চাইছে রাজ্য সরকার। এবং রীতিমতো প্রতিযোগিতা বলেই থাকছে পুরস্কার। ফাঁকি দিলে থাকছে জবাবদিহির দায় ও দাওয়াই।
এই ব্যবস্থার প্রথম ধাপে মেডিক্যাল কলেজের নীচের স্তরের সব সরকারি হাসপাতালের সার্জন ও গাইনোকলজিস্ট বা স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞদের কাজের খতিয়ান নিল এবং ‘পারফরম্যান্স’ মাপল সরকার। ব্যাপারটা নিছক মাপামাপিতেই শেষ হচ্ছে না। দেওয়া হচ্ছে ‘র্যাঙ্ক’। তার ভিত্তিতেই দেওয়া হবে পুরস্কার।
প্রয়াত চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র যখন সরকারি হাসপাতালের কাজকর্মের উপরে নজরদারি চালানোর জন্য গড়া স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মাল্টিডিসিপ্লিনারি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখনই চিকিৎসকদের কাজের নিরিখে ‘র্যাঙ্ক’ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। ভাল কাজের জন্য পুরস্কার এবং ফাঁকি মারার জন্য তিরস্কারের উপরেও জোর দেন তিনি। বস্তুত তাঁর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই গত জানুয়ারিতে সার্জন এবং স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞদের মাসিক পারফরম্যান্সের তথ্য চেয়ে পাঠানো শুরু হয় হাসপাতালের কাছে।
এই ধরনের পরীক্ষা-সমীক্ষা বা খতিয়ান নেওয়া হয় অনেক সময়েই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরে সব চাপাও পড়ে যায়। তাই সংশ্লিষ্ট মহল ধরে নিয়েছিল, এ ক্ষেত্রে ঘটা করে তথ্য চেয়ে পাঠানো হলেও আখেরে তেমনটাই হবে। কিন্তু ন’মাস পরে সকলকে কার্যত চমকে দিয়ে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সার্জারি বা অস্ত্রোপচারের সংখ্যার ভিত্তিতে চিকিৎসকদের কে কোন স্থান পেয়েছেন, তার দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য দফতর। তাতে দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত ‘মেজর’ বা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচারের সংখ্যার নিরিখে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়— তিনটি স্থানই দখল করেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা হাসপাতাল এমআর বাঙুরের তিন গাইনোকলজিস্ট। আবার স্ত্রীরোগ ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সার্জারির সংখ্যার নিরিখে প্রথম তিনটি স্থানে রয়েছেন পুরুলিয়া জেলা হাসপাতালের তিন সার্জন। তালিকায় দেখা যাচ্ছে, কোনও হাসপাতালে এক জন সার্জন হয়তো মাসে বড় ধরনের ৩৫০টি অস্ত্রোপচার করেছেন। আবার অনেক হাসপাতালে কোনও কোনও চিকিৎসক হয়তো মেরেকেটে অস্ত্রোপচার করতে পেরেছেন ২২টি!
‘‘কে কতটা কাজ করছেন আর কে ফাঁকি দিচ্ছেন, সেটা এই তালিকা থেকে বোঝা যাবে। তার ভিত্তিতে ভালদের পুরস্কৃত করা হবে আর জবাবদিহি করতে হবে ফাঁকিবাজদের,’’ বললেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তিনি জানান, শুধু সার্জন নয়, অন্যান্য বিষয়ের চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের ‘পারফরম্যান্স অডিট’ হবে। এর কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মাল্টিডিসিপ্লিনারি কমিটির অন্যতম সদস্য শান্তনু সেন বলছেন, ‘‘যে-কোনও ক্ষেত্রে কাজকর্মের মান উন্নয়নের তাগিদে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতেই হয়।’’
তবে এই ব্যবস্থার সমালোচনাও করছেন চিকিৎসকদের একাংশ এবং কিছু হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। বামপন্থী সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিসেস ডক্টর্সের তরফে গৌতম মুখোপাধ্যায় যেমন বলেন, ‘‘জেলা, মহকুমা বা স্টেট জেনারেল হাসপাতালের অনেক জায়গায় বেশি অস্ত্রোপচার করার পরিকাঠামোই নেই। সর্বত্র অ্যানাস্থেটিস্টের চরম আকাল। সার্জন বা গাইনোকলজিস্টেরা তাই চাইলেও কাজ করতে পারছেন না।’’ অন্য এক প্রবীণ ডাক্তারের অনুযোগ, অনেক জায়গায় বড় অস্ত্রোপচারের পরে রোগীকে স্থিতিশীল করার জায়গা নেই, যন্ত্রপাতি নেই। গ্রুপ-ডি কর্মী এবং নার্সও এত কম যে, বেলা ২টো পর্যন্ত শুধু ‘কোল্ড কেস’ বা পূর্বনির্ধারিত অস্ত্রোপচার হয়। তার পরে আর ‘ইমার্জেন্সি’ বা জরুরি অস্ত্রোপচার করা যায় না। অনেক জায়গাতেই আছেন এক বা দু’জন চিকিৎসক। শুধু প্রসবের জন্য ‘সিজার’ করা ছাড়া স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত অন্য অস্ত্রোপচারের সময়ই পান না তাঁরা।
সমালোচকদের অনেকে অবশ্য বলছেন, ‘‘অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা বিচার্য হতে পারে না। অস্ত্রোপচারের মানটাই আসল।’’
স্বাস্থ্যকর্তাদের অধিকাংশই অবশ্য এই পদক্ষেপ সমর্থন করে জানান, সার্জন ও স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞদের একাংশের বিরুদ্ধে হাসপাতালে সময় না-দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস চালিয়ে যাওয়া, বেলা ২টোর পরে কোনও জরুরি অস্ত্রোপচার না-করা, সপ্তাহের বেশ কয়েকটা দিন জেলার হাসপাতাল থেকে কলকাতায় চলে আসার ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। সেগুলোর মোকাবিলায় এই ধরনের র্যাঙ্কিং আর পুরস্কারের ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে। স্বাস্থ্যেও তৈরি হতে পারে সুস্থ প্রতিযোগিতার আবহ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy