Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

দেহ যাতে না ভাসে, বুকে বাঁধা পাথর

পরনের লুঙ্গি দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুনের পরে দেহ ময়ূরেশ্বরের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। পুলিশে দায়ের করা অভিযোগে সন্তোষ খয়ড়ার (২২) পরিবারের সংযোজন ছিল, ‘‘জলে ডোবা দেহ ভেসে ওঠা ঠেকাতে দড়ি দিয়ে ভারী পাথর বেঁধে দেওয়া হয়।’’

বিচারের অপেক্ষায় নিহত সন্তোষের মা।—অনির্বাণ সেন

বিচারের অপেক্ষায় নিহত সন্তোষের মা।—অনির্বাণ সেন

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৬ ০২:৫২
Share: Save:

•২০০৪-এর ৭ জানুয়ারি খুন হন সাঁইথিয়ার দইকোটা গ্রামের যুবক, পেশায় দিনমজুর সন্তোষ খয়ড়া (২২)।

•জলে ডোবা দেহ ভেসে ওঠা ঠেকাতে দড়ি দিয়ে ভারী পাথর বেঁধে দেওয়া হয় বলে তদন্তে জানতে পারে পুলিশ।

•মৃতের পরিবারের দাবি, মাছ চুরির কীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে বুঝেই অভিযুক্তেরা পরিকল্পনা করে খুন করে।

•পুলিশের দাবি, মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে। জানে না পরিবারই।

পরনের লুঙ্গি দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুনের পরে দেহ ময়ূরেশ্বরের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। পুলিশে দায়ের করা অভিযোগে সন্তোষ খয়ড়ার (২২) পরিবারের সংযোজন ছিল, ‘‘জলে ডোবা দেহ ভেসে ওঠা ঠেকাতে দড়ি দিয়ে ভারী পাথর বেঁধে দেওয়া হয়।’’

২০০৪ এর ৭ জানুয়ারি সাঁইথিয়ার দইকোটা গ্রামের বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর ওই যুবককে খুন করা হয় বলে তদন্তে জানতে পারে পুলিশ। সপ্তাহ খানেক বাদে সন্তোষের মা সাবিত্রীদেবী এলাকারই পাঁচ যুবক কানন খয়ড়া, বিষ্ণু খয়ড়া, বলরাম খয়়়ড়া ও তাঁর ভাই কালো এবং সঞ্জীব মালের নামে অভিযোগ দায়ের করেন। ধরা পড়ে কানন ও বিষ্ণু। তিন মাসের মাথায় দু’জনেই জামিন পায়। পুলিশ জানায়, সাক্ষ্য শুরুর আগের দিন কানন আত্মহত্যা করে। এ দিকে, সুযোগ বুঝে অন্যতম অভিযুক্ত বিষ্ণু ঝাড়খণ্ড পালায়। ওইটুকই। সাবিত্রীদেবীর কথায়, ‘‘প্রথম প্রথম পুলিশ তৎপর হয়েছিল। এখন ‘ডে়ট’ কবে পরে সেটুকুও জানতে পারি না!’’

কেন খুন?

সন্তোষের পরিবারের দাবি, মাছ চুরির কীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে বুঝেই অভিযুক্তেরা পরিকল্পনা করে খুন করেছে। সাবিত্রীদেবীর কথায়, ঘটনার দিন বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয় সন্তোষ। পাশের সাউলডিহি গ্রাম থেকে মদ কিনে খায়। তিনি বলেন, ‘‘পরে এলাকার লোকজনের মুখে শুনি ওই দিন গ্রামের পথ দিয়ে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিল গ্রামের জামাই বিষ্ণু। ওর সাইকেলে ওঠার আবদার করে সন্তোষ। সাইকেলে নিতে না চাইলে রেগে গিয়ে সন্তোষ বলে, তুমি আজও কালুয়ার পুকুরে মাছ চুরি করেছ। এর আগেও করেছ। সে সব বলে দেব।’’

অভিযোগ, এরপরেই অপকীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে সন্তোষকে শ্বাসরোধ করে খুন করে বিষ্ণু। সাবিত্রীদেবীর দাবি, খুন করার পরে দেহ লোপাটের জন্যে বিষ্ণু অন্য চার অভিযুক্তকে ডাকে। তারপরেই বাগডোলার সঞ্জীব, দইকোটার বলরাম ও তাঁর ভাই কালো এবং দেড়িয়াপুরের কানন মিলে দেহে পাথর বেধে ময়ূরাক্ষীর গভীর জলে ফেলে দেয়। এ দিকে, ছেলে বাড়ি ফিরছে না দেখে পরিজনদের মনে হয় হয়তো কোথাও গিয়েছে! একদিন ঠিক ফিরে আসবে। ৩৩ দিন পর ফিরে এল পচাগলা দেহ। মৃতের পরিজনদের দাবি, তারপরেই এলাকার লোকজনের মুখে মুখে সন্তোষের মদ খেতে যাওয়া, সাইকেলে চড়ার আবদার ইত্যাদি ঘটনা পরম্পরা সামনে আসতে শুরু করে। ‘‘একটির পর একটির ঘটনার যোগসূত্র দেখেই ওই পাঁচ জনের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করি’’— যুক্তি সাবিত্রীদেবীর।

মাঠে নামে পুলিশ। ঘটনার দিন দশেক পরে অভিযুক্ত কানন গ্রেফতার হয়। তার দিন কয়েক বাদে সিউড়ি আদালতে আত্মসমর্পণ করে বিষ্ণু। ৯০ দিন জেল হাজতে থাকার পরে দু’জনেরই জামিন হয়। ঘটনার বছর দেড়েক পরে সাক্ষ্য শুরু হবে বলে সিউড়ি আদালত থেকে সন্তোষের মা এবং স্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু, সাক্ষ্য শুরুর আগের দিনই কানন আত্মঘাতী হতে পিছিয়ে যায় মামলা। সন্তোষের প্রৌঢ়া মায়ের অভিযোগ, ‘‘তারপর থেকে আর আদালতে ডাক পরেনি। মাঝে মধ্যে থানা ও আদালতে গিয়েছিলাম। কেউ ঠিক করে কিছু বলে না...’’

মামলার ঠিক কী অবস্থা?

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ২০১২ সালেই ওই মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে। তবে পাঁচ জন নয়, দু’জনের নামে মামলা হয়েছিল। তারা সিউড়ি আদালত থেকেই বেকসুর খালাস পেয়েছে।’’ এমন কথা শুনে কার্যত আকাশ থেকে পড়ছেন সাবিত্রীদেবী। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এক পক্ষের কথা শুনে কী করে মামলার নিষ্পত্তি হল? আমাদের তো সাক্ষ্যই নেওয়া হয়নি!’’ গোটা ঘটনা শুনে সরকারি কৌঁসুলি রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রতিক্রিয়া, ‘‘নতুন করে অভিযোগ দায়ের হলে মামলা ফের চালু করা হবে।’’ বেকসুর খালাসের কথা জানা নেই বলে দাবি করেছেন আসামীপক্ষের কৌঁসুলি রাজেন দে। তাঁর কথায়, ‘‘দু’জনের জামিনের পরে অভিযুক্ত বা তাঁদের পরিবারের তরফে যোগাযোগই করা হয়নি।’’

এ ভাবে খুনের ঘটনার নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে শুনে ক্ষোভ উগরেছেন দইকোটা গ্রামের অনেকেই। এঁদের অনেকে গোটা ঘটনার তদন্ত দাবি করছেন। এলাকার এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘পুলিশ ফের তদন্ত শুরু করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করুক।’’ বহু চেষ্টার পরেও অভিযুক্তদের কারও সঙ্গেই অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি।

এ দিকে, পরিবারের এক মাত্র রোজগেরে মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। অভাবের তাড়নায় সাবিত্রীদেবী দইকোটার ভিটে ছেড়ে ভবানীপুরের রাস্তার ধারে ছোট ছেলের পরিবারের সঙ্গে থাকেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কথা ভেবে দুই মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি বর্ধমানে চলে গিয়েছেন সন্তোষের স্ত্রী। বড় মেয়ে মিনতি এ বারে মাধ্যমিক দিয়েছে। ছোট অনিতা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।

আর্থিক সমস্যার মধ্যে থেকেও তদন্তের শেষ দেখতে চান সাবিত্রীদেবীও। কান্নাভেজা কাঁপা স্বরে তিনি বলছেন, ‘‘ওদের শাস্তি দেখে না গেলে মরেও শান্তি পাব না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

stone ties
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE