Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বনস্পতির ছায়া রামপ্রসাদ স্যারের গুরুকুলে

গুরুকুল প্রথা উঠে গিয়েছে কবে। বর্ধমানের কাঁকসা বোধ হয় ব্যতিক্রম। সেখানে অনেক পড়ুয়াকে এখনও পথ দেখাচ্ছে এক ‘গুরুকুল’। ‘বনস্পতি’ হয়ে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের সহায় হচ্ছেন গুরু। রামপ্রসাদ স্যার।

নিজের বাড়িতে পড়ুয়াদের সঙ্গে রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: বিপ্লব ভট্টাচার্য।

নিজের বাড়িতে পড়ুয়াদের সঙ্গে রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: বিপ্লব ভট্টাচার্য।

সুব্রত সীট
কাঁকসা শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০৩:৪৮
Share: Save:

গুরুকুল প্রথা উঠে গিয়েছে কবে। বর্ধমানের কাঁকসা বোধ হয় ব্যতিক্রম। সেখানে অনেক পড়ুয়াকে এখনও পথ দেখাচ্ছে এক ‘গুরুকুল’। ‘বনস্পতি’ হয়ে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের সহায় হচ্ছেন গুরু। রামপ্রসাদ স্যার।

অভাবের সংসারে কাউকে পড়া ছেড়ে চাষের কাজ করতে বলেছিল বাড়ির লোক। কারও বাবা-মা পড়ার খরচ জোটাতে পারবেন না বলে হাত তুলে নিয়েছিলেন। বর্ধমানের কাঁকসায় এমন বহু পড়ুয়ার কাছেই মুশকিল-আসান অযোধ্যা গ্রামের রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। নানা বাধায় এক সময়ে যাদের স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হতে বসেছিল, কাউকে বাড়িতে রেখে, কারও বইপত্র কিনে দিয়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। এখন তাঁদেরই কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ কাজ করছেন পুলিশে।

প্রাচীন ভারতে গুরুগৃহেই অধ্যয়ন করতে হতো। ছান্দোগ্য উপনিষদে শ্বেতকেতুর উপাখ্যান থেকে জানা যায়, বারো বছর গুরুর কাছে থেকে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। জবালা উপাখ্যানের সত্যকাম সম্ভবত তার চেয়েও বেশি দিন গুরুর আশ্রয়ে ছিলেন। মধ্যযুগেও সেই রীতি প্রচলিত ছিল। নবদ্বীপের পণ্ডিতদের কাছে স্মৃতি, নব্যন্যায় পড়তে আসতেন পূর্ব ভারতের অনেক ছাত্র। সেই রীতি পরে উঠেই গিয়েছিল।

কাঁকসায় সেই ধরনটিই যেন ফিরিয়ে এনেছেন রামপ্রসাদবাবু। প্রায় দু’দশক আগে যে রীতির শুরু। রামপ্রসাদবাবু তখন বনগ্রাম প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। তাঁর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত অভাবি পরিবার থেকে আসা এক ছাত্রী। ২০০১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নিতে গিয়ে এক দিন দেখেন, টেবিলের তলায় লুকিয়ে আছে এক ছাত্র। জিজ্ঞাসা করে জানেন, সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। শারীরিক ভাবে দুর্বল। সহপাঠীদের ভয়ে লুকিয়েছে এই ক্লাসে। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে তাঁর মোটরবাইকের পিছনে উঠে বসে শুভম পাতর নামে ওই ছাত্র। তার পর থেকে তার দায়িত্ব এই শিক্ষকের।

শুভমের বাবা বনমালীবাবু চালকলের রক্ষী। মাসে আয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতে থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা শুভম এখন সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ইংরেজির স্নাতক। তার ভাই সন্দীপকেও বাড়িতে রেখে পড়িয়েছেন রামপ্রসাদবাবু। এ বার ৬৪৩ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে সে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি নিয়ে চিন্তায় পড়েছিল সন্দীপ। স্যার বলে দিয়েছেন, ‘‘তোর উচ্চ মাধ্যমিক আর তোর দাদার স্নাতকোত্তরের পড়ার সব ভাবনা আমার।’’ বনমালীবাবু বলেন, ‘‘আমাদের কাছে উনিই ভগবান।’’

রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতে গেলেই দেখা মেলে বাপি হেমব্রম, রীতা পাতর, প্রশান্ত টুডু, আয়েষা খাতুনদের। বাড়িতে অনটনের কারণে বছর তিনেক আগে বাপিকে দু’পয়সা রোজগারের রাস্তা দেখতে বলেছিলেন বাড়ির লোকজন। বাপি হাজির হয় রামপ্রসাদবাবুর কাছে। রামপ্রসাদবাবু যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে নেন। রীতা ছয় বোনের মধ্যে পঞ্চম। বাবা দিনমজুর। গরু চরানো, বাড়ি-বাড়ি দুধ পৌঁছনোর পরে পড়াশোনা করা রীতার পক্ষে মুশকিল ছিল। তারও দায়িত্ব নেন ‘স্যার’। এ বার রীতা মাধ্যমিক পাশ করেছে। তার বাবা নরেন পাতর বলেন, ‘‘উনি না থাকলে কবে মেয়ের পড়া বন্ধ হয়ে যেত!’’

আলিনগর গ্রামের মনিকা বেসরার পড়ার খরচ জোটাতে হিমসিম খাচ্ছিল পরিবার। মনিকার জন্য পুরনো একটি সাইকেলের ব্যবস্থা করে বাড়িতে পড়তে আসতে বলেন রামপ্রসাদবাবু। জানিয়ে দেন, যা প্রয়োজন হবে, তিনি দেবেন। মনিকা এখন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। তাঁর মতোই পুলিশকর্মী সুনীল মাড্ডি, প্রাথমিক শিক্ষিকা শোভা মুর্মুরা এক সময়ে পড়াশোনা নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। ত্রাতা সেই ‘স্যার’। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক ফাল্গুনী দে-র স্মৃতিচারণ, ‘‘স্যারের কাছে পড়তে পেরে জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে।’’

বছর ছয়েক আগে রামপ্রসাদবাবু কাঁকসার সাতকাহানিয়া প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১২-এ একটি মামলায় জডিয়ে ‘সাসপেন্ড’ হন। পরে কাজে যোগ দিলেও বেতন হয়ে যায় অর্ধেক।
অবসর নিতে বাকি মাস সাতেক। কিন্তু অভাবী পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়াতে
কার্পণ্য নেই। খরচ চলে কী করে? রামপ্রসাদবাবু জানান, বিঘে দশেক জমি আছে। বছরভর ভাতের জোগাড় সেখান থেকেই হয়ে যায়। মেয়ে সুদেষ্ণার বিয়ে হয়েছে ২০০৯-এ। ছেলে রামানুজ বিশ্বভারতীতে গবেষণার পাশাপাশি সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে আংশিক সময়ের শিক্ষকতা করছেন। রামপ্রসাদবাবু বলেন, ‘‘খরচ বাঁচাতে খুব সাধারণ জীবনযাপন শুরু করেছিলাম। অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।’’

শিক্ষকের স্বীকারোক্তি, তাঁকে সঙ্গ দিতে গিয়ে সব শখ-আহ্লাদ ত্যাগ করেছেন তাঁর স্ত্রী মিনতি। কেন? রামপ্রসাদবাবুকে ঘিরে বসা পড়ুয়াদের দেখিয়ে মিনতিদেবী বলেন, ‘‘এ-ই তো আমার তীর্থ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Student Poverty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE