নতুন বইয়ের খোঁজে। মেদিনীপুর বইমেলায়। — নিজস্ব চিত্র।
বইমেলার শেষ দিন রবিবার। তাই ছুটির দিনে নতুন বইয়ের খোঁজে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েন তপনবাবু। যদিও মেলায় ঘুরে শেষ পর্যন্ত তিনি বাড়ি নিয়ে ফিরলেন ‘চিরকালের সেরা রবীন্দ্রনাথ’। শুক্রবার সন্ধ্যায় বইমেলায় গিয়েছিলেন মেদিনীপুরের কমার্স কলেজের শিক্ষক বিবেকানন্দ দাসমহাপাত্র। বাড়িতে নিয়ে এসেছেন ‘শরত্ সাহিত্য সমগ্র’। তাঁর কথায়, ‘‘এ বার শরত্ সমগ্র কিনেছি। আসলে এই সব বই বাড়িতে পড়ে থাকে না। পরিবারের সকলে পড়ে। পরিচিত লেখকদের ক্ষেত্রে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে।’’
স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকেই রয়েছে প্রথিতযশা লেখকদের কবিতা। বিক্রেতারাও জানাচ্ছেন, বইমেলায় চেনা- পরিচিত লেখকদের বই- ই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, বইমেলায় যে সংখ্যক বই বিক্রি হয়েছে, তার ৬০- ৭০ শতাংশই পরিচিত লেখকদের। এক প্রকাশনা সংস্থার কর্মীর কথায়, “স্টল থেকে ৫০টি বই বিক্রি হলে তার ৩০- ৩৫টিই পরিচিত লেখকের।” কোন লেখকের বই বেশি বিক্রি হচ্ছে? বইমেলার স্টলগুলোয় ঢুঁ মেরে জানা গেল, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, আশাপূর্ণাদেবী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রেমেন্দ্র মিত্রদের বই-ই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
এক প্রকাশনা সংস্থার কর্মী কার্তিক ঘোড়ই বলেন, ‘‘আসলে অনেকেই নতুন পাঠকের বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেন না। বইটা কেমন হবে, সেই নিয়ে একটা ধন্দ থেকেই যায়। পরিচিত লেখকের বই নিলে এই ধন্দটা থাকে না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পাঠকের হাতে নতুন লেখকের বই তুলে দিতে হলে অনেক বোঝাতে হয়। কেন কিনবেন, লেখার গুণগত মান কেমন, সব বলতে হয়। সব শুনে সন্তুষ্ট হলে তখনই পাঠক নতুন লেখকের বই নেন। শুধু মেদিনীপুর বলে নয়, অন্যত্রও ছবিটা প্রায় একই।’’ প্রায় একই বক্তব্য আরেক প্রকাশনা সংস্থার কর্মী তাপস সর্দারের।
বইমেলায় ছোটদের বইয়ের একটা চাহিদা থাকেই। ছোটদের বইয়ের মধ্যে বেশি বিকোচ্ছে কিশোর গল্প, মজার গল্প, ইস্কুলের গল্প, ইশপের গল্প, ঠাকুমার ঝুলি, শার্লক হোমস প্রভৃতি। মেদিনীপুরের মতো মফস্সলের বইমেলায় চেনা-পরিচিত লেখকদের বই বেশি বিক্রি হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করেন মেদিনীপুর কলেজের শিক্ষক তথা বইমেলা ও মৈত্রী উত্সব সমিতির যুগ্ম সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ বাগ। তাঁর কথায়, “এটা একটা ‘ট্রেন্ড’। আমরা তো বিখ্যাতদের নিয়েই মাতামাতি করি। কারণ, তাঁদের উপর একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়। খুব দ্রুত ছবিটা পাল্টাবে না।” সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “নতুন লেখকদেরও সুন্দর সুন্দর লেখা থাকে। এখনকার বিখ্যাত লেখকেরা তো এক সময় লিটল ম্যাগাজিন থেকেই উঠে এসেছেন।”
শুধু সাধারণ পাঠক নয়, বই নিয়ে মগ্ন থাকা পাঠকেরও এখন সময় কমছে। বিশ্বাসযোগ্যতা একটা বড় ব্যাপার। পরিচিত লেখকদের সেটা তৈরি হয়ে গিয়েছে। অনেকেই বইমেলায় এলে এক- দু’টো বই নিয়ে তবেই বাড়ি ফেরেন। সেই ক্ষেত্রে তাঁরা পরিচিত লেখকের বই-ই নেন, বলে চলেন মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন আকাদেমির সম্পাদক তথা বাংলার শিক্ষক ঋত্বিক ত্রিপাঠী। তাঁর কথায়, “অর্থ এবং সময়- এই দু’টোকে মূল্য দিতে গিয়েই পাঠকদের একটা বড় অংশ নতুন লেখকদের দিকে ঝুঁকছেন না। তাঁরা পরীক্ষা- নিরীক্ষার দিকে যাচ্ছেন না!”
গত রবিবার থেকে মেদিনীপুরে শুরু হয়েছে বইমেলা। উদ্যোক্তা বইমেলা ও মৈত্রী উত্সব সমিতি। আজ, রবিবারই মেলার শেষ দিন। এক প্রকাশনা সংস্থার কর্মী অমল বেজ বলেন, “এক সময় নতুন লেখকদের বই বিক্রি হত। এখন অবশ্য নতুন লেখকদের বই বিক্রি কমেছে। চেনা- পরিচিত লেখকদের বই- ই বেশি বিক্রি হচ্ছে।” উদ্যোক্তা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা সঙ্গীতশিল্পী অলোকবরণ মাইতির জানাচ্ছেন, ‘নৌকাডুবি’, ‘চাঁদের পাহাড়’- এ সব তো আজও প্রাসঙ্গিক। অপুর ছেলেবেলা বাঙালির কাছে এক নস্টালজিয়া। মেদিনীপুরের মতো মফস্সলের বইমেলায় এ সব বই তো বিক্রি হবেই। চাঁদের পাহাড়ের গল্পটাই তো কি দারুণ।
বইমেলা উপলক্ষে প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আসা নবীন শিল্পীদের হাতেও সমিতির পক্ষ থেকে বই তুলে দেওয়া হয়। সুধীন্দ্রনাথবাবু বলছিলেন, “এই ক’দিনও ভিড় ভালই হয়েছে। আসলে বইপ্রেমীরা বইমেলায় আসবেনই। মেলায় কত নতুন বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সময়ের হাত ধরে ভাললাগা ও ভালবাসা বদলায়। কত পুরনো বই নতুন করে পড়া যায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy