এসএসকেএমের এক অনুষ্ঠানে অন্যদের সঙ্গে রোশন আলি। এ রাজ্যে তার দেহেই প্রথম সফল ভাবে প্রতিস্থাপিত হয় লিভার। নিজস্ব চিত্র
বিভিন্ন সময়ে এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে ওঠে একাধিক অভিযোগ। রোগী-বিক্ষোভ, তাকে কেন্দ্র করে ভাঙচুরের ঘটনাও প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু এ সবের মাঝেও ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে গত দশ বছরে সরকারি পরিষেবার এক অন্য ছবি উঠে আসছে।
১০ বছর আগে রাজ্যের প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন করে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, গত পাঁচ মাসে সে পথে অনেকটা এগিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। পরিসংখ্যান এবং সাফল্যের সেই ঊর্ধ্বমুখী লেখচিত্রকে আরও দৃঢ় করেছে ওঁদের মুখের হাসি। রাজমিস্ত্রি রজাব আলির ছেলে রোশন আলি, জোগানদার ভূদেব বাগদির দুই ছেলে অনিমেষ ও অনিরুদ্ধ, নদিয়ার তাহেরপুরের কৃষক চণ্ডীচরণ ঘোষ, বারুইপুরের অটোচালক জয়প্রতিম ঘোষ— এঁরা সকলেই সাফল্যের এক একটি মুখ। ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করাতে গিয়ে পর্যুদস্ত পরিবারগুলির অবশেষে সহায় হয়েছিল লিভার প্রতিস্থাপনে অনুমোদন পাওয়া একমাত্র সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম।
চিকিৎসকদের মতে, যত বেশি সরকারি হাসপাতাল এই পরিষেবা দিতে সক্ষম হবে, তত সাধারণ মানুষের নাগালে আসবে এই চিকিৎসা। পাশাপাশি, গত তিন বছরে বেড়েছে অঙ্গদানের প্রক্রিয়া। ফলে মৃতের পরিবার সেই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়ে চিকিৎসাকে সাধ্যের মধ্যে আনছে বলে মনে করছে চিকিৎসক মহল।
গত ১০ বছরে এসএসকেএম হাসপাতালের ‘স্কুল অব ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড লিভার ডিজিজে’র (এস ডি এল ডি) চিকিৎসকেরা ‘ব্রেন ডেড’ এবং জীবিতের লিভারের অংশ নিয়ে মোট ১৭ জনের শরীরে তা প্রতিস্থাপন করেছেন। ১৩টি ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে ৭টি সাফল্যই এসেছে গত পাঁচ মাসে। ১০ বছরে চার জন শিশুর শরীরে লিভার প্রতিস্থাপিত হয়েছে, মারা গিয়েছে এক জন শিশু।
একটি শিশুকে নতুন জীবন দিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে এখনও দৃষ্টি ঝাপসা হয় রাবেয়ার। রোশনের বয়স তখন মাত্র তিন মাস। পেট ব্যথায় একটানা কেঁদে চলা ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে বর্ধমানের বাসিন্দা দম্পতি জানতে পারেন, খারাপ ধরনের জন্ডিস হয়েছে ছেলের। বিভিন্ন ডাক্তার দেখিয়ে অবশেষে ছেলেকে নিয়ে এসএসকেএমে আসেন রাবেয়ারা। মাস দু’য়েক পরে জানতে পারেন, শিশুটির লিভার বদলাতে হবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল রাজমিস্ত্রি রজবের। পরীক্ষানিরীক্ষার পরে চিকিৎসকেরা জানান, রজব ছেলেকে লিভারের অংশ দিতে পারবেন।
সেই রোশন এখন ছটফটে, আর পাঁচটি সুস্থ বাচ্চার মতোই বেড়ে উঠছে। সেই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১০ সালে ব্রেন ডেড এক রোগীর লিভার এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা প্রতিস্থাপন করেন জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায় নামে এক রোগীর শরীরে। সেটি ছিল রাজ্যের প্রথম ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট’। যদিও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। সংখ্যায় কম হলেও ২০১১-২০১৭ সালের মধ্যে জীবিত দাতার থেকে লিভারের অংশ নিয়ে প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া এসএসকেএমে জারি ছিল। এর মধ্যে কিছু ব্যর্থতাও আসে। তবু পিছিয়ে যাননি চিকিৎসকেরা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জানুয়ারির মধ্যে দু’জনের শরীরে জীবিত দাতার লিভারের অংশ এবং ৫টি ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট করেছে এসএসকেএম। এই ৭টি প্রতিস্থাপনের সবক’টিই সফল বলে জানাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রোগী নির্বাচন এবং চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা এর প্রধান কারণ বলে মনে করেন হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী। তাঁর মতে, ‘‘১০ বছর আগে পরিকাঠামো যা ছিল, সেই একই পরিকাঠামোয় এখনও ওই অস্ত্রোপচার হচ্ছে। রোগী যদি গুরুতর অসুস্থ থাকেন, তবে লিভার প্রতিস্থাপন করলে মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায়। প্রথম দিকে উদ্দীপনার বশে সেই নির্বাচনে কিছু ত্রুটি হচ্ছিল। সেই সঙ্গে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা তো আছেই। এগুলিই সাফল্যের কারণ।’’
সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি, এ শহরের বেসরকারি হাসপাতাল অ্যাপোলোর লিভার প্রতিস্থাপনের লাইসেন্স রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রের খবর, ‘লাইভ’ এবং ‘ক্যাডাভার’ মিলিয়ে তাঁরা ১৮ জনের শরীরে লিভার প্রতিস্থাপন করেছেন। জীবিত দাতার লিভারের অংশ তাঁরা প্রথম প্রতিস্থাপন করেন ২০১২ সালে।
সরকারি হাসপাতালের এই সাফল্য দেখে এগিয়ে আসছে বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালও। রাজ্যের স্পেশ্যাল সেক্রেটারি (মেডিক্যাল এডুকেশন) এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপনে এ রাজ্যের নোডাল অফিসার তমাল ঘোষ বলেন, “এই মুহূর্তে এসএসকেএম এবং অ্যাপোলো ছাড়াও লিভার প্রতিস্থাপনের লাইসেন্স রয়েছে ফর্টিস এবং রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেসের। মেডিকার তরফে অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেই প্রক্রিয়া চলছে।” লাইসেন্স পাওয়া অন্য দু’টি হাসপাতাল এখনও লিভার প্রতিস্থাপন শুরু করেনি বলে জানাচ্ছেন তিনি।
চিকিৎসকদের মতে, অসংখ্য মানুষের কাছে এই চিকিৎসা পৌঁছে দিতে দুর্গা সাধু, অদিতি সিংহ, সজল কর এবং মধুস্মিতা বায়েনের দৃষ্টান্ত দেখে অঙ্গদানে শামিল হোক আরও পরিবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy