Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সূর্যের সন্ন্যাসী দর্শনে দূরত্ব ঘোচার জল্পনা

হাসপাতালে রামকৃষ্ণ মিশনের অসুস্থ প্রেসিডেন্ট মহারাজের শয্যাপার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ালেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। আরোগ্য কামনার বার্তা নিয়ে। এমনিতে নিখাদ সৌজন্য। কিন্তু তার আড়ালেই কি আসলে ভেঙে গেল দীর্ঘদিনের এক ভেদরেখা? বিরোধী দলনেতা যদি সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য হন এবং একই সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক, তা হলে এমন প্রশ্ন উঠবেই।

স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে সূর্যকান্ত মিশ্র। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র।

স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে সূর্যকান্ত মিশ্র। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০৪:১৭
Share: Save:

হাসপাতালে রামকৃষ্ণ মিশনের অসুস্থ প্রেসিডেন্ট মহারাজের শয্যাপার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ালেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। আরোগ্য কামনার বার্তা নিয়ে।

এমনিতে নিখাদ সৌজন্য। কিন্তু তার আড়ালেই কি আসলে ভেঙে গেল দীর্ঘদিনের এক ভেদরেখা?

বিরোধী দলনেতা যদি সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য হন এবং একই সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক, তা হলে এমন প্রশ্ন উঠবেই। কারণ, রামকৃষ্ণ মিশন এবং সিপিএমের সম্পর্ক যে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের রহস্যে মোড়া। তাই সৌজন্যমূলক পদক্ষেপকেও নেহাত সৌজন্য হিসাবে দেখতে চাইছেন না অনেকে। জ্যোতি বসুর পরে কোনও পদে আসীন কোনও কমিউনিস্ট নেতা রামকৃষ্ণ মিশনের কোনও সন্ন্যাসীর কাছে গিয়েছেন বলে মনে করতে পারছেন না প্রবীণ বামপন্থীরাই। সিপিএমের ঘরের লোক থেকে এখন বিজেপি-শিবিরে যাওয়া এক ব্যক্তির মন্তব্য, ‘‘রামকৃষ্ণ মিশন এখন অচ্ছুৎ নয় তা হলে!’’ মঙ্গলবার বিকেলে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে স্বামী আত্মস্থানন্দকে দেখতে যাওয়া সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য দাবি করেছেন, এমন কোনও ছুৎমার্গের তত্ত্ব তাঁদের কোনও দিনই ছিল না।

শনিবার কলকাতা এসে স্বামী আত্মস্থানন্দকে দেখতে যাওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও। কিন্তু মোদীর সঙ্গে বেলুড় মঠের সম্পর্ক নিয়ে নতুন কোনও জল্পনার অবকাশ নেই। সূর্যবাবুদের বেলায় সেটা ঘোরতর ভাবে আছে। ফলে জল্পনা শুরু হয়েছে, সাধারণ জনমানসে রামকৃষ্ণ মিশনের বিপুল প্রভাব মাথায় রেখেই কি এখন বিরোধী আসনে থাকা সিপিএমের নতুন মূল্যায়ন? তাই কি স্বামী আত্মস্থানন্দের কাছে যাওয়া?

সূর্যবাবু বলছেন, বিষয়টিকে রাজনৈতিক তত্ত্বের মোড়কে না দেখাই ভাল। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বরাবরই ভাল। শুধু আমি বলে নয়, আমাদের অনেকের সঙ্গেই ভাল। মন্ত্রী থাকার সময়েও তো ওঁদের ওখানে গিয়েছি। বেলুড় মঠে ভোজ পর্যন্ত করিয়েছেন ওঁরা!’’ বাম আমলে রহড়ায় রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত একটি কলেজ ঘিরে সরকারের সঙ্গে মিশনের বিরোধ বাধে। কলেজ পরিচালনায় সরকারি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মামলা করেছিলেন মিশন কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় সেই মামলা। এই বিরোধ চলাকালীন গোলমালে কলেজের বামপন্থী শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ। আর তার পর থেকেই আমজনতার মনে ধারণা ছড়িয়েছিল যে, সিপিএম মানেই রামকৃষ্ণ মিশনের বিরোধী। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, আসলে তা নয়। সূর্যবাবু যেমন দাবি করছেন, তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বামফ্রন্ট সরকার চেয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল করুক। তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত দফতরে থাকার সময়ে ওঁদের সঙ্গে সর্বশিক্ষা অভিযানের কাজ করেছি। কোথাও কোনও অসুবিধা তো ছিল না!’’

প্রবীণ বাম নেতারা অবশ্য বলছেন, জ্যোতিবাবুর আমলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে মিশনের মামলা হলেও একমাত্র তাঁর সঙ্গেই বেলুড় মঠের ভাল সম্পর্ক ছিল। সস্ত্রীক বেশ কয়েক বার ভরত মহারাজের কাছে গিয়েছেন জ্যোতিবাবু। বেলুড় মঠের মন্দির ঘুরে দেখেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের পৈত্রিক বাড়ি অধিগ্রহণ করে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রেও জ্যোতিবাবুর বিশেষ ভূমিকা ছিল। সিপিএমের অন্দরে জ্যোতিবাবুর ভাবশিষ্য বলেই পরিচিত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং সুভাষ চক্রবর্তীও রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। তবে তাঁদের ‘ব্যতিক্রম’ই বলতে চান বামেদের একাংশ।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সচরাচর এই ধরনের প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়ে চলতেন। সিপিএমের অন্য নেতাদের সঙ্গেও রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পর্ক সহজ ছিল না। বিরোধী দলনেতা স্বামী আত্মস্থানন্দকে দেখতে গিয়েছেন শুনে আনন্দবাজারের কাছে এ দিন সোমনাথবাবুর সহর্ষ প্রতিক্রিয়া, ‘‘সূর্য গিয়েছিল? খুব ভাল করেছে! ভাল মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অসুবিধা কীসের?’’ লোকসভার স্পিকার হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি নিজে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের খোঁজখবর নিতে যেতেন জানিয়ে সোমনাথবাবুর প্রশ্ন, ‘‘সুভাষের কথা আলাদা ঠিকই। কিন্তু কমিউনিস্ট হলে রামকৃষ্ণ মিশন বা অন্য কোথাও ভাল মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে না কেন?’’ কিন্তু যোগাযোগ যে ক্ষীণ ছিল, একই সঙ্গে তা-ও অস্বীকার করছেন না লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার।

সিপিএমের মধ্যে একাংশের ব্যাখ্যা, সীতারাম ইয়েচুরি সাধারণ সম্পাদক এবং সূর্যবাবু রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে দলে এখন উদার-যুগ! যে কারণে সূর্যবাবুকে ফুরফুরা শরিফে পরবের সময়ে দেখা যাচ্ছে। আবার রামকৃষ্ণ মিশনের অসুস্থ সন্ন্যাসীর কাছে যেতেও তাঁর বাধা নেই! তৃণমূলের এক রাজ্য নেতা (মিশন ও মঠে যাঁদের যাতায়াত বরাবরই অকুণ্ঠ) যদিও কটাক্ষ করছেন, ‘‘কালে কালে আরও কত কী হবে? ঠেকায় পড়ে কত কী করবেন ওঁরা!’’ সূর্যবাবু অবশ্য অবিচল— ‘‘এত আশ্চর্যের তো কিছু নেই! মিশন হিসাবে ওঁদের ধর্মনিরপেক্ষ মনে করি, এ কথাও তো আগে বলেছি!’’

‘ধর্মে’র প্রতি মনোভাব বদলাচ্ছেন কমিউনিস্টরা? জল্পনা জোরালো হল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE