Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মুখ্যমন্ত্রীর রোষে সাসপেন্ড ৬ বছর, কী আছে কপালে? জানতে চান সেই ডাক্তার

সকলের পুনর্বাসন হয়ে গেল। শুধু তিনি ছাড়া। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম রোষের বলি তিনি। প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ায় পদ গিয়েছিল তাঁর।

এখন শ্যামাপদ গড়াই।—নিজস্ব চিত্র।

এখন শ্যামাপদ গড়াই।—নিজস্ব চিত্র।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৭
Share: Save:

সকলের পুনর্বাসন হয়ে গেল। শুধু তিনি ছাড়া।

২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম রোষের বলি তিনি। প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ায় পদ গিয়েছিল তাঁর। সাসপেন্ডও হয়েছিলেন। ছ’বছর পরেও সেই সাসপেনশন না ওঠায় গোটা বিষয়টি কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তা জানতে চেয়ে স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি দিয়েছেন বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন)–এর প্রাক্তন অধিকর্তা শ্যামাপদ গড়াই।

বিভাগীয় তদন্ত চালানোর নামে অনন্তকাল এই ভাবে কোনও সরকারি কর্মীকে কেন সাসপেন্ড করে বসিয়ে রাখা হবে, চিঠিতে তা জানতে চেয়েছেন শ্যামাপদবাবু। তাঁর অভিযোগ, বারবার স্বাস্থ্য দফতরের কাছে তদন্ত রিপোর্টের হাল জানতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেউ কোনও জবাব দেয়নি। সাসপেন্ড থাকা অবস্থাতেই তাঁর অবসর নেওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ। কিন্তু চিকিৎসক-শিক্ষকদের অবসরের বয়স বেড়ে ৬৫ হওয়ায় এখন ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ অবসর নেবেন তিনি। এমতাবস্থায় অবসরের পরে আর্থিক পাওনাগণ্ডার কী হবে, সে ব্যাপারেও স্বাস্থ্য ভবন থেকে কোনও সদুত্তর পাননি ওই চিকিৎসক।

স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্ল এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়েছেন শ্যামাপদবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘সময় তো অনেক নেওয়া হল। আমাকে বাঁচানো হোক বা মারা হোক— স্বাস্থ্য দফতর যেন আমার ভাগ্যে কী রয়েছে সেটা এ বার জানিয়ে দেয়। এটা আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে।’’

শ্যামাপদবাবুর দাবি, বিআইএন-এর অধিকর্তার পদ ছিল ‘প্র্যাকটিসিং পোস্ট।’ অর্থাৎ এই পদে থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা যায়। সেই মতো তিনি এখন প্র্যাকটিস করছেন। তবে সাসপেন্ড অবস্থায় প্র্যাকটিস করতে পারেন কি না, তা জানতে চেয়েও স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দিয়েছিলেন শ্যামাপদবাবু। তারও কোনও উত্তর আসেনি। ২০১১ সালের মে মাসের পর থেকে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোনও বেতন আসেনি বলেও দাবি করেছেন শ্যামাপদবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘সাসপেনশন চলাকালীন বেতনের বেসিক বা বেসিকের অর্ধেক কেটে বাকিটা কর্মীকে দেওয়ার কথা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কিছুই দেওয়া হয়নি।’’

তিনি আদালতের দ্বারস্থ হলেন না কেন? শ্যামাপদবাবু বলেন, ‘‘আমি আদালতে মামলা ঠুকলে মুখ্যমন্ত্রী ম্যাডামকে স্বয়ং আসতে হতো।’’ অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিষয়টিকে তাই তিনি আদালতে টেনে নিয়ে যেতে চাননি বলে মন্তব্য করেন ওই চিকিৎসক।

তারিখটা ছিল ২০১১ সালের ২৬ মে। যে দিন আচমকা বিআইএন পরিদর্শনে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন হাসপাতালের তৎকালীন অধিকর্তা। শ্যামাপদবাবুর দাবি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বা ওঁকে অপমানের প্রশ্নই ছিল না। উনি কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। আমি যতটা সম্ভব উত্তর দিচ্ছিলাম।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি একটা হাসপাতালের অধিকর্তা। আমারও তো একটা আত্মসম্মান রয়েছে। বোকার মতো চুপ করে থাকবো কেন?’’

কিন্তু কেন এমন হল? শ্যামাপদবাবুর কথায়, ‘‘আমি চার বছর বিআইএনের অধিকর্তা থাকাকালীন সবাইকে সময়মতো হাসপাতালে আসতে এবং নিয়মিত অপারেশন করতে বাধ্য করেছিলাম। আশপাশের নার্সিংহোমে রোগী রেফার আটকেছিলাম। সেই রাগে কেউ আমার সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছিল।’’

আরও পড়ুন:

মেঝেতে কাটল রাত, জেল কোনও আবদার মানল না, ব্রেকফাস্টে চাটনি-ভাত

২০১১ সালের জুলাইয়ে শ্যামাপদবাবুকে শো-কজ করা হয়। চার্জশিট দেওয়া হয় ওই বছরেরই ডিসেম্বরে। তিনি তার উত্তর দেওয়ার পরে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ পার্থজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিশন তৈরি হয়। ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কমিশনে শ্যামাপদবাবুর শুনানিও হয়। তার পর থেকে সব চুপচাপ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য দফতরে একের পর এক চিঠি দিয়েও তিনি কোনও উত্তর পাননি বলে দাবি করেছেন শ্যামাপদবাবু। তার পর চিঠি দেওয়া বন্ধ করে দেন।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্লর মন্তব্য, ‘‘২০১১ সালের ব্যাপার। আমার তেমন জানা ছিল না। আমাকে কেউ বলেওনি।’’ যিনি স্বাস্থ্যসচিব থাকাকালীন ঘটনাটি ঘটেছিল সেই মানবেন্দ্রনাথ রায়ের কথায়, ‘‘পুরনো কথা মনে রাখা উচিত নয়। তাতে সমস্যা বাড়ে।’’ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘কেন এত দিনে তদন্ত শেষ হয়ে রিপোর্ট পেশ হল না, আমি জানি না।’’ যিনি তদন্ত চালিয়েছিলেন সেই পার্থজিৎবাবুর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘দ্রুত তদন্ত শেষ করে আমি রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরের তৎকালীন বিশেষ সচিব সুকুমার ভট্টাচার্যকে জমা দিয়েছিলাম।’’ পার্থজিৎবাবু এবং সুকুমারবাবু দু’জনেই ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন। সুকুমারবাবুর মন্তব্য, ‘‘৬ বছর আগের কথা আমি সব ভুলে গিয়েছি!’’

গত ছ’বছরে স্বাস্থ্য দফতরে অন্তত ৭ জন চিকিৎসক-শিক্ষককে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানোর পরেও আবার কাজে ফেরানো হয়েছে। ২০১৪ সালে উত্তরবঙ্গে যখন এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণ হয়, তখন স্বাস্থ্য ভবনকে সময়

মতো ওয়াকিবহাল না-করার অভিযোগে চার স্বাস্থ্যকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। তাঁদেরও পুনর্বহাল করা হয়েছে।

ব্যতিক্রম শুধু শ্যামাপদবাবুই। কেন? রহস্যজনক ভাবে মুখে কুলুপ সকলেরই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Suspension Doctor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE