Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পুরভোটে শাসকের সেনানী সিন্ডিকেটই

কলকাতা হোক বা কাঁচরাপাড়া। উলুবেড়িয়া হোক বা শিলিগুড়ি। পুরভোটের দিন বুথের বাইরে-ভিতরে দেদার অপরিচিত মুখ দেখে চমকে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দলে দলে এত অচেনা তরুণ! কারা এরা? প্রশ্ন ছিল তাঁদের। পুরভোটের ফলাফল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে শাসক দলের অন্দর মহল থেকেই! সদ্যসমাপ্ত পুরভোটে তৃণমূলের যুদ্ধজয়ের নেপথ্যে বড় ভূমিকায় ছিল সিন্ডিকেট বাহিনী। নিজেদের বকেয়া পাওনা আদায়ের তাগিদে এক জায়গা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে গিয়ে শাসক দলের হয়ে যারা ভোট ‘করিয়ে’ দিয়ে এসেছে! কখনও নিজেরা হাতে-কলমে, কোথাও আবার বাইরের ‘অতিথি’দের আপ্যায়ন করে এবং এলাকা চিনিয়ে ‘দায়িত্ব’ পালন করেছে তারা!

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৫ ০৩:২২
Share: Save:

কলকাতা হোক বা কাঁচরাপাড়া। উলুবেড়িয়া হোক বা শিলিগুড়ি। পুরভোটের দিন বুথের বাইরে-ভিতরে দেদার অপরিচিত মুখ দেখে চমকে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দলে দলে এত অচেনা তরুণ! কারা এরা? প্রশ্ন ছিল তাঁদের।

পুরভোটের ফলাফল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে শাসক দলের অন্দর মহল থেকেই! সদ্যসমাপ্ত পুরভোটে তৃণমূলের যুদ্ধজয়ের নেপথ্যে বড় ভূমিকায় ছিল সিন্ডিকেট বাহিনী। নিজেদের বকেয়া পাওনা আদায়ের তাগিদে এক জায়গা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে গিয়ে শাসক দলের হয়ে যারা ভোট ‘করিয়ে’ দিয়ে এসেছে! কখনও নিজেরা হাতে-কলমে, কোথাও আবার বাইরের ‘অতিথি’দের আপ্যায়ন করে এবং এলাকা চিনিয়ে ‘দায়িত্ব’ পালন করেছে তারা!

ভোটের আগে জনমত সমীক্ষা ও আরও নানা ইঙ্গিত যতই শাসক দলের পক্ষে থাকুক, কলকাতা এবং রাজ্যের আরও ৯১টি পুরসভার নির্বাচনে কোনও ‘ঝুঁকি’ নেওয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সেই মতোই ছক কষা হয়েছিল। ভোটের পরে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র (ইভিএম) খুললে যাতে তৃণমূলের জন্য বিশেষ বিস্ময়ের কোনও কারণ না থাকে, তার জন্য যেখানে সম্ভব, সেখানেই ভোটের দিন ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ করা ছিল। তৃণমূল সূত্রের খবর, সেই পরিকল্পনার অন্যতম কান্ডারি ছিল সিন্ডিকেট বাহিনী! প্রসঙ্গত, সিন্ডিকেট-রাজের সঙ্গে দলের নেতাদের না জড়াতে একাধিক বার সতর্ক করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু সিন্ডিকেটের সঙ্গে শাসক দলের নেতাদের আঁতাঁতের বহু অভিযোগ বহু বার উঠেছে। সিন্ডিকেটের দাপটও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এ বারের পুরভোট তাকেই অন্য মাত্রায় তুলে নিয়ে চলে গিয়েছে।

ভোট-পর্ব মিটে যাওয়ার পরে সিন্ডিকেটের ‘নেপথ্য’ কাহিনি পর্দার বাইরে আসছে। উত্তর ২৪ পরগনার রাজারহাট এলাকার এক সিন্ডিকেট সদস্যের কথায়, ‘‘মাস চারেক আগে থেকেই আমাদের সব পাওনা টাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ করেছি আমরা। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের তরফে নির্দিষ্ট ঠিকাদার অথবা মালিক গোষ্ঠীকে বকেয়া না মেটানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’’ নির্বাচনের পরেই পাওনা টাকা মিলবে বলে স্থানীয় নেতারা সিন্ডিকেট বাহিনীকে জানিয়েও দিয়েছিলেন।

শাসক দলের নেতারা এই ‘নেপথ্য’ কাহিনির কথা মানতে নারাজ। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘কোথায় ছাপ্পা হল, তা-ই জানতে পারলাম না! তার পরে ফের কারা দিল, তাদের কী ভাবে বেঁধে রাখা হয়েছিল, কী ভাবে বলব!’’

শহরে শহরে নানা সিন্ডিকেটের কাছে এত দিনে অবশ্য ‘ভোট করাও, পাওনা নাও’ তত্ত্ব অজানা নেই! দক্ষিণ শহরতলির ই এম বাইপাস লাগোয়া এলাকার এক সিন্ডিকেটের সদস্য যেমন বলছেন, ‘‘নির্বাচনের বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেলেরা এসে হাজির হয়েছিল। ওদের এলাকা চেনানো থেকে খাবার ও মদের খরচ, সবই আমাদের বইতে হয়েছে! কিছু ক্ষেত্রে দলের তরফে দেওয়া হয়েছে। তবে তা যৎসামান্য!’’ ওই সিন্ডিকেট সদস্যের আরও দাবি, ‘‘বহিরাগত যারা আমাদের এলাকায় এসেছিল, তারাও নিজেদের এলাকার সিন্ডিকেটের সদস্য বলেই আমাদের কাছে দাবি করেছে। এবং ওদেরও বকেয়া পাওনা বন্ধ করে রাখা হয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে।’’

পুলিশের একটি সূত্রের খবর, নানা এলাকায় সিন্ডিকেটের লোকজনই ‘ছাপ্পা ভোট’ করেছে। বুথের চার ধারে শাসক দলের সমর্থকদের উপরে বিশেষ নজরদারির নির্দেশ না থাকলেও ভোটের দিন আশেপাশের এলাকার সিন্ডিকেট সদস্যদের পরিচিত মুখই পুলিশের চোখে ধরা পড়েছে। এলাকার ও বহিরাগত সিন্ডিকেটের যৌথ বাহিনীই বুথ দখল করে ‘ছাপ্পা’ মেরে গিয়েছে বলে নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক পুলিশ কর্মীর বক্তব্য।

হাওড়ার গোলাবাড়ি এলাকার আর এক সিন্ডিকেট সদস্যের দাবি, ‘‘কলকাতা পুরসভার ভোটে মূলত বহিরাগতেরাই বুথের ভিতরে গিয়ে ছাপ্পা দিয়েছে। আর এলাকার সিন্ডিকেটের সদস্যেরা বুথের বাইরের পরিস্থিতি সামলেছে।’’ গত ১৮ এপ্রিল কলকাতা পুরসভা ভোটের দিনসাতেক আগেই হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, ভাঙড়, রাজারহাট, বিষ্ণুপুর এলাকার বহিরাগতেরা বিভিন্ন ওয়ার্ড এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকার সিন্ডিকেট সদস্যদের আস্তানায় ডেরা বেঁধেছিল বহিরাগতেরা। ভোট শেষ হওয়ার পরেই এলাকা ছেড়ে চলে যায় তারা। একই ভাবে ২৫ এপ্রিল অন্যান্য জেলার পুরসভা নির্বাচনে কলকাতার সিন্ডিকেটের সদস্যেরা ‘ভোট করতে’ গিয়েছিলেন নানা এলাকায়। সকলের ক্ষেত্রেই কয়েক মাস আগে থেকে সিন্ডিকেটের সব বকেয়া বন্ধ করে রাখা হয়েছিল!

ই এম বাইপাস সংলগ্ন এক সিন্ডিকেট সদস্যের বক্তব্য, ‘‘আমাদের উপরে জোর নজরদারি ছিল। কোন বুথে ক’টা ভোট কোন সময়ে দেওয়া হয়েছে, তা স্থানীয় নেতাদের লিখিত ভাবে জানাতে হয়েছে। গণনার পরে তা মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তার পরই বকেয়া বরাদ্দ দেওয়ার জন্য ঠিকাদারদের সুপারিশ করা হয়েছে!’’ কয়েক জনের ক্ষেত্রে লিখিত বয়ান অনুযায়ী গণনার হিসেব না মেলায় বকেয়া বরাদ্দ আটকেও গিয়েছে! সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত কিছু লোকজনই বলছেন, বাম জমানাতেও স্থানীয় নেতাদের নির্দেশে কিছু এলাকার ছাপ্পা ভোট নিয়ন্ত্রণে তাঁদের ভূমিকা থাকত। রাজারহাট সংলগ্ন এলাকার এক সিন্ডিকেট সদস্যের কথায়, ‘‘কিন্তু ওই সময়ে বকেয়া বরাদ্দ আটকানো হতো না। কিন্তু এখন নিজেদের ভোট নিশ্চিত করতে আগেই বকেয়া বরাদ্দ আটকানো হচ্ছে!’’

কিন্তু শাসক দলের নেতারা কেন সিন্ডিকেটকে আর্থিক বাঁধনে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করেছেন? এক সিন্ডিকেট সদস্যের মতে, অনেক সিন্ডিকেটের লোকজনই বাম জমানার। তাই সিন্ডিকেটের মধ্যেও ‘বাম ভূত’ দেখেছে শাসক দল! তা ছাড়া, সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে শাসক দল নিজেরাই মনে করছে, তারা একটু চাপে আছে। তাই কোনও ‘ঝুঁকি’ নেননি শাসক দলের নেতারা। সব কিছুই নজরদারিতে রেখেছেন। বকেয়া আটকে সিন্ডিকেটের সদস্যদের উপরে চাপ রেখেছিলেন। যাতে বেচাল কিছু ঘটলেই সব হাতছাড়া হওয়ার ভয় থাকে! কোনও কোনও সিন্ডিকেটের লোকজনের প্রায় দুই থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা বকেয়া আটকে রাখা রয়েছে। একটু এ দিক-ও দিক হলেই পাওনা বন্ধ। আবার ভবিষ্যতে কাজও জুটবে না। ভূত-ভবিষ্যৎ ঝরঝরে হওয়ার আশঙ্কায় অগত্যা শাসক দলকে ছাপ না দিয়ে কোনও উপায় ছিল না বলেই সিন্ডিকেট ও পুলিশ সূত্রের বক্তব্য!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE