Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

রোগী, মিটিং, নেতার ফোন, ক্লাসে পড়াব কখন?

সোমা মুখোপাধ্যায় কলকাতা পরিস্থিতিই কি ‘বাধ্য’ করছে এ রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষায় প্রতি পদে এমন আপসে? এ প্রশ্নও উঠেছে, অল্পে বাজিমাতের যে প্রবণতা চারপাশে শিকড় ছড়াচ্ছে, তা থেকে ডাক্তারেরাই বা মুক্ত থাকবেন কী ভাবে?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:১১
Share: Save:

‘‘সকাল থেকে ওয়ার্ডে রোগী দেখা। যত বেড, তার দ্বিগুণ রোগী। সে সব সামলাতে না সামলাতেই বিভাগের কয়েকটা মিটিং। তার পরে নেতা-মন্ত্রীর আট-দশটা ফোন। তাঁদের নির্দেশ মানার জন্য কয়েক প্রস্ত ছোটাছুটি। এই সব করতেই বেলা দেড়টা বেজে যাচ্ছে। ক্লাস করাব কখন?’’ আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের যে শিক্ষক-চিকিৎসক এই কথা বললেন, তাঁর গলায় হতাশা চাপা থাকেনি। তাঁর কথায়, ‘‘সবাই যে ইচ্ছা করে ফাঁকি দেয়, তা নয়। পরিস্থিতি বাধ্য করে।’’

পরিস্থিতিই কি ‘বাধ্য’ করছে এ রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষায় প্রতি পদে এমন আপসে? এ প্রশ্নও উঠেছে, অল্পে বাজিমাতের যে প্রবণতা চারপাশে শিকড় ছড়াচ্ছে, তা থেকে ডাক্তারেরাই বা মুক্ত থাকবেন কী ভাবে? এক প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসকের কথায়, ‘‘আগে জানতাম, আমাদের কাজের মধ্যে ৫০ শতাংশ রোগী পরিষেবা, ৪০ শতাংশ পড়ানো এবং ১০ শতাংশ গবেষণা। এখন ১০০ শতাংশই রোগী পরিষেবা হয়ে গিয়েছে। বাকি কাজগুলোর আর জায়গাই নেই।’’

পঠনপাঠন কার্যত শিকেয় উঠলেও মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞেরা অনেকেই মনে করছেন, যথাযথ পরিকাঠামোর ব্যবস্থা না করে এ ভাবে একের পর এক কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত মেডিক্যাল শিক্ষাকে আরও বেশি করে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জোকার ইএসআই মেডিক্যাল কলেজটিকে ধরলে বর্তমানে এ রাজ্যে ১৪টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে দু’হাজারেরও বেশি আসন। রয়েছে পাঁচটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজও। ২০১৯ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ চালুর কথা ডায়মন্ড হারবার, রায়গঞ্জ, রামপুরহাট, পুরুলিয়া, কোচবিহারে।
অদূর ভবিষ্যতে আরও ছ’টি কলেজ খোলার প্রস্তুতি চলছে।

কোথা থেকে শিক্ষক-চিকিৎসক পাওয়া যাবে? এখানে সেই পুরনো অভ্যাস। এক জায়গা থেকে শিক্ষক নিয়ে অন্য জায়গা ভরাট করার চেষ্টা। গত শুক্রবারই বদলি এবং পদোন্নতি সংক্রান্ত এক সরকারি নির্দেশিকায় মাথায় হাত পড়েছে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের। পাঁচটি নতুন কলেজে এমসিআই-এর পরিদর্শন শীঘ্রই। তার আগে অন্য কলেজ থেকে ওই পাঁচ জায়গায় শিক্ষক পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু যেখান থেকে তাঁদের পাঠানো হচ্ছে, সেখানে কী ভাবে কাজ চলবে, তার উত্তর নেই।

স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে শুধু তাঁদের দুষে লাভ নেই। মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার নিয়মেই প্রচুর গলদ রয়েছে। দিল্লি থেকে এমসিআই কর্তারাও জানিয়েছেন, দেশ জুড়ে ডাক্তারের আকাল। এই কারণে জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ খোলার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। শিথিল করা হয়েছে কলেজের ছাড়পত্র পাওয়ার নিয়মকানুনও। অর্থাৎ পরিকাঠামো থাকছে না জেনেও সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টায় সায় রয়েছে এমসিআই-এরও। স্রেফ ‘মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চন’-এর উত্তর দিয়ে ফি বছর ডাক্তাররা পাশ করে বেরোবেন জেনেও এমসিআই তা মেনে নিচ্ছে? উত্তর দিতে পারেননি
এমসিআই কর্তারা।

সদ্য পাশ করা এক এমবিবিএস ডাক্তারের বক্তব্য, তাঁরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষ থেকেই এমডি প্রবেশিকার ফাউন্ডেশন কোর্সে ভর্তি হচ্ছেন, সে কথা ঠিক। কিন্তু কেন হচ্ছেন? তাঁর কথায়, ‘‘এমবিবিএস–এর যত আসন, সেই তুলনায় এমডি-এমএস এর আসন বাড়ছে না। তাই সেখানে প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে। সেখানকার প্রশ্নপত্রও পুঁথিগত বিদ্যা নির্ভর হয়ে উঠছে। সব মিলিয়ে এমবিবিএস পড়াকালীনই একটি ছেলে বা মেয়ে বাধ্য হচ্ছে কলেজের ক্লাস ফেলে কোচিং ক্লাসে ঢুকতে। কারণ, তাঁর উপরে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতার চাপ তৈরি হচ্ছে।’’

শল্য চিকিৎসক সুমিত চৌধুরীও মনে করছেন, এ এক ‘অন্ধ গলি’, যা বিভিন্ন দেশেই মেডিক্যাল শিক্ষা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি তৈরি করছে। শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়, ‘‘ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময়েই বাবা-মায়েরা কোচিং সেন্টারে ঢোকাচ্ছেন, সন্তানদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার করার জন্য। ফলে পরবর্তী সময়ে এমবিবিএস পড়ার সময়ে ওয়ার্ডে সময় না দিয়ে তারা এমডি-এমএস এর প্রস্তুতির জন্য কোচিং সেন্টারে থাকলে, দোষ দেবেন কী করে?’’

চিকিৎসক তথা প্রাক্তন শিক্ষক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘মেডিক্যাল কলেজ আর সাধারণ হাসপাতালের মধ্যে ফারাক করতে পারছে না প্রশাসন। ভোটের রাজনীতিকে মাথায় রেখে সব ধরনের রোগীরই মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ঠাঁই হচ্ছে। মেডিক্যাল কলেজ যে আদতে রোগী পরিষেবার জন্য নয়, ভবিষ্যতের ডাক্তার তৈরি করার জন্য, সেটা প্রশাসনকেই বুঝতে হবে।’’

স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র স্বীকার করে নিয়েছেন এই সমস্যার কথা। তাঁর কথায়, ‘‘জেলায় জেলায় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে এই কারণেই। কিন্তু যাঁদের সেখানে নিয়োগ করা হচ্ছে, তাঁদের অনেকেই দূরে থাকেন। ট্রেন ধরার তাড়ায় দুপুরের পরে হাসপাতাল ফাঁকা হয়ে যায় বহু জায়গায়। এটা আটকাতে স্থানীয় ভাবে থাকার ব্যবস্থার উপরে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জেলা স্তর থেকে মেডিক্যাল কলেজে রোগী রেফারও নিয়ম মেনে করতে বারবার বলা হচ্ছে। সমস্যাটা এক দিনে কমার নয়। ধীরে ধীরে কমছে।’’

তত দিনে কি অনেক দেরি হয়ে যাবে না? পঠনপাঠনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় যুক্ত রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মতে, পরিকাঠামোর কথা ভেবে তবেই কলেজ খোলার কথা ভাবা উচিত। মেডিক্যাল শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার জন্যও কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। তা না করে শুধু সংখ্যার দৌড়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করলে এ রাজ্য ভবিষ্যতে যে মানের ডাক্তার পেতে চলেছে, তা বহু ক্ষেত্রেই ভয়াবহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Doctor Frustration Class Student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE